শনিবার, ৭ আগস্ট, ২০১০

বাড়িতে আলু সংরক্ষণের পদ্ধতি

বাড়িতে আলু সংরক্ষণের পদ্ধতি

দেশে এবার আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তু হিমাগারের অভাবে আলু সংরক্ষণে সমস্যা হচ্ছে; নষ্ট হচ্ছে। আলু প্রতি কেজি ৫ থেকে ৬ টাকা দরে কৃষকরা বিক্রি করছে। দেশে এবার প্রায় এক কোটি টনের মত আলু উৎপাদন হয়েছে। অথচ দেশে অবস্থিত মোট ৩৩৭টি হিমাগারের মোট ধারণ ক্ষমতা ২২ লাখ টন। অর্থাৎ উৎপাদিত আলুর মাত্র পাঁচ ভাগের এক ভাগ আলু সংরক্ষণ করা যায়। প্রতি বছর শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ আলু নষ্ট হয়।

প্রায় ৭ থেকে ৮ মাস আলু সংরক্ষণ করতে হয়। হিমাগার ছাড়াও কৃষকরা নিজ বাড়িতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আলু সংরক্ষণ করতে পারেন। হিমাগারের এক বস্তা আলু সংরক্ষণ করতে ২৫ থেকে ৩০০ টাকা খরচ হয়। কৃষকরা বাড়িতে আলু সংরক্ষণ করলে খরচ পড়ে প্রতিবস্তা মাত্র ২০ থেকে ২৫ টাকা। এ জন্য কৃষকরা সহজেই বাড়িতে আলু সংরক্ষণ করতে পারেন। নিচে আলু সংরক্ষণের পদ্ধতি বর্ণনা করা হলো :

আলু সংগ্রহের পর প্রখর সূর্যালোকে আলু রাখা ঠিক নয়। এতে আলুতে ব্যাকহার্ট রোগ হতে পারে। আলু সংগ্রহের পর কাটা, রোগাক্রান্ত, পচা, ক্ষত, থ্যাতলানো ও বেশি ছোট আলু বাদ দিতে হয়। শুধু ভাল আলু গুদামে রাখা উচিত। আলো-ছায়ায় শুকিয়ে গুদামজাত করতে হবে।
একটাও আলু যাতে ভেজা না থাকে সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।

গুদামজাতকরণ : তুলনামূলকভাবে ঠাণ্ডা ও বায়ু চলাচল করে এমন শুষ্কস্থানে আলু সংরক্ষণ করতে হয়। বাঁশের চাটাইয়ের বেড়া এবং ছনের ছাউনি দিয়ে ভূমি থেকে বাঁশের খুঁটি দিয়ে উচুঁ করে ঘর তৈরি করতে হয়। আলুর শ্বাস-প্রশ্বাসের তাপ বের হওয়া এবং বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। মেঝেতে বাঁশের চাটাই কিংবা বালু বিছিয়ে এর ওপর স্তুপাকারে আলু রাখতে হবে। তবে স্তুপ যেন এক মিটার উঁচু এবং ২ মিটারের বেশি প্রশস্ত না হয় এবং যথেষ্ট বায়ু চলাচলের সুবিধা থাকে। ২ থেকে ৩টি তাক করে স্তরে স্তরে স্তুপ করে আলু রাখা যেতে পারে। পাত্রে আলু সংরক্ষণ করা যায়। বাঁশের ঝুড়ি, ডোল বা বাঁশের ও মাটির যে কোনো পাত্রে আলু রাখা যায়। এক্ষেত্রে পাত্রগুলো ঠাণ্ডা স্থানে রাখতে হবে। আলুর রোগ ও পোকা দ্বারা আক্রমণ রোধ করার জন্য নিম, নিশিন্দা, বিষ কাটালি ইত্যাদির পাতা গুঁড়ো করে আলুর স্তুপে মিশিয়ে দেয়া যেতে পারে। তবে কীটনাশক দেয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে, ক্ষেত্রে আলু পরিপক্ব হওয়ার সময় থেকে আলুর সুপ্তাবস্থা শুরু হয়। আলু গুদামে রাখার কিছুদিন আগেও সুপ্তাবস্থা শুরু হতে পারে। মোটামুটিভাবে কোনো মারাত্মক ক্ষতি ছাড়া আলুর সুপ্তাবস্থা শেষ হওয়া থেকে প্রায় এক মাস অথবা অঙ্কুরোদগম পুরোপুরি শুরু হওয়া পর্যন্ত আলু গুদামে রাখা যেতে পারে। অর্থাৎ প্রায় ৭ থেকে ৮ মাস আলু এভাবে সংরক্ষণ করা যায়।

পর্যবেক্ষণ : ১৫ দিন পর পর সংরক্ষিত আলু দেখতে হবে। খারাপ গন্ধ হলে বুঝতে হবে দু’একটি আলু পচেছে। পচা আলু সরাতে হবে। ইঁদুরের উপস্থিতির কোনো লক্ষণ দেখলে ইঁদুর মারতে হবে। পোকা-মাকড় ও রোগ-জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত আলু বাছাই করতে হবে। স্তুপের নিচের আলু উপরে এবং উপরের আলু নিচে নেড়ে দিতে হবে।

বীজ হিসেবে রাখা আলুর অঙ্কুর গজানো শুরু হলেই আলাদাভাবে গুদামজাত করতে হবে। যেখানে দিনের আলো পড়ে (কিন্তু সকালে এবং দিনের শেষ ভাগ ছাড়া সরাসরি সূর্যের আলো পড়ে না) এমন স্থানে তাক বা মেঝের উপর ২ থেকে ৩টি স্তরে আলু গুদামজাত করা যায়। অঙ্কুর গজানো শুরু হলেই বুঝতে হবে বায়ু চলাচলকৃত গুদামে আলু আর বেশি দিন রাখা যাবে না। সুতরাং বীজ আলু পরিত্যক্ত আলুর গুদামে স্থানাস্তর করতে হবে।
লেখক : ফরহাদ আহাম্মেদ, কৃষিবিদ, শিক্ষক ও সাংবাদিক
তথ্যসূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক

চাষি পর্যায়ে আলু সংরক্ষণ

গত বছর হিমাগারের অভাবে আলু সংরক্ষণ করা যায়নি বলে প্রচুর আলু পচে গেছে। অপর দিকে হিমাগারে আলু সংরক্ষণ খরচও বেশি। হিমাগারে এক বস্তা আলু রাখতে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা লাগে। চাষিরা নিজেরাই আলু সংরক্ষণ করলে খরচ হয় মাত্র ১০ থেকে ২০ টাকা। দেশে প্রতি বছর যে পরিমাণ আলু উৎপাদন হয় সে পরিমাণ হিমাগার নেই। প্রতি বছরই আলু পচে যায় এবং অল্প দামে বিক্রি করে। চাষিরা নিজের বাড়িতে সহজেই আলু সংরক্ষণ করতে পারেন। আলু পরিপক্ব হওয়ার পর থেকে উফশী জাত দু-তিন মাস এবং দেশী জাতের সুপ্তাবস্খা চার-ছয় মাস থাকে। ক্ষেতে আলু পূর্ণ বৃদ্ধি হওয়ার ১০ থেকে ১৪ দিন পর অর্থাৎ গাছ মরতে শুরু করলে আলু সংগ্রহ করতে হবে। মাটি ভেজা অবস্খায় কোনোক্রমেই ফসল সংগ্রহ করা উচিত নয়। আলু স্খানান্তর যত্নের সাথে করতে হবে এবং শক্ত মেঝের ওপর ফেলা ঠিক নয়।

সংরক্ষণ পদ্ধতি : আলু সংগ্রহের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাঠ থেকে আলু সরানো উচিত এবং প্রখর সূর্যালোকে ফেলে রাখা উচিত নয়। এতে আলুর ব্ল্যাক হার্ট রোগ হতে পারে। আলু সংগ্রহের পর কাটা, রোগাক্রান্ত, পচা, ক্ষত, থেঁতলানো ও বেশি ছোট আলু বাছাই করতে হবে। শুধু ভালো আলু গুদামে রাখা উচিত। আলু ছায়াযুক্ত স্খানে শুকিয়ে গুদামজাত করতে হবে। একটা আলুও যাতে ভেজা না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

গুদামজাতকরণ : তুলনামূলকভাবে ঠাণ্ডা ও বায়ু চলাচল করে এমন স্খানে আলু সংরক্ষণ করতে হয়। বাঁশের চাটাইয়ের বেড়া এবং ছনের ছাউনি দিয়ে ভূমি থেকে বাঁশের খুঁটি দিয়ে উঁচু করে ঘর তৈরি করতে হয়। টিউবার (আলু) জীবন্ত উদ্ভিদাংশ বলে শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় তাপ সৃষ্টি করে ও পানি বের করে দেয়। এ তাপ গুদামজাতকালীন সময় বায়ু চলাচলের মাধ্যমে অবশ্যই বের করে দিতে হবে। এ জন্য তাপ বের হওয়া ও বায়ু চলাচলের ব্যবস্খা করতে হবে। মেঝেতে বাঁশের চাটাই কিংবা বালু বিছিয়ে এর ওপর স্তূপাকারে আলু রাখতে হবে। তবে আলুর স্তূপ যেন তিন ফুট উঁচু ও ছয় ফুটের বেশি প্রশস্ত না হয় এবং যথেষ্ট বায়ু চলাচলের সুবিধা রাখতে হবে। দু-তিনটি তাক করে স্তরে স্তরে স্তূপ করে আলু রাখা যেতে পারে। বাঁশের ঝুড়ি, ডোল বা বাঁশের ও মাটির যেকোনো পাত্রে আলু রাখা যায়। এ ক্ষেত্রে পাত্রগুলো ঠাণ্ডা স্খানে রাখতে হবে। আলু পোকামাকড় দ্বারা আক্রান্ত রোধ করার জন্য নিম, নিশিন্দা, বিষকাটালি ইত্যাদি পাতা গুঁড়ো করে আলুর স্তূপে মিশিয়ে দেয়া যেতে পারে। তবে কীটনাশক দেয়া যাবে না।
মনে রাখতে হবে, ক্ষেতে আলু পরিপক্ব হওয়ার সময় থেকেই আলুর সুপ্তাবস্খা শুরু হয়। আলু গুদামে রাখার কিছু দিন আগেও সুপ্তাবস্খা শুরু হতে পারে। মোটামুটিভাবে কোনো মারাত্মক ক্ষতি ছাড়া আলুর সুপ্তাবস্খা শেষ হওয়া থেকে প্রায় এক মাস অথবা অঙ্কুরোদগম পুরোপুরি শুরু হওয়া পর্যন্ত আলু গুদামে রাখা যেতে পারে। অর্থাৎ প্রায় সাত-আট মাস আলু এভাবে সংরক্ষণ করা যায়।

পর্যবেক্ষণ : ১৫ দিন পর পর গুদামে বা পাত্রে সংরক্ষিত আলু দেখতে হবে। খারাপ গìধ হলে বুঝতে হবে দু-একটি আলু পচেছে। পচা আলু সরাতে হবে। ইঁদুরের কোনো চিহ্ন দেখলে বা টের পেলে ইঁদুর মারার ব্যবস্খা করতে হবে। স্তূপের নিচের আলু ওপরে এবং ওপরের আলু নিচে নেড়ে দিতে হবে। আলু ভিজে গেলে হালকা রোদে শুকিয়ে আবার গুদামজাত করতে হবে।

রোগ ও পোকা দমন : গুদামে আলু সংরক্ষণ করার পর জাবপোকা ও আলুর টিউবার মথ দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। জাবপোকা দমনের জন্য গুদামের আশপাশে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। নিম, নিশিন্দা, ল্যান্টানা, বিষকাটালির পাতা গুঁড়ো করে আলুতে দিতে হবে। টিউবার মথ দমনের জন্য ক্ষেতে আলু মাটি দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। মথ দ্বারা ছিদ্র করা আলু বাছাই করা, খুব শুকনো বালু দিয়ে আলু গুদামে ঢেকে রাখা উচিত। গুদামজাত অবস্খায় সৃষ্ট রোগের অধিকাংশ জীবাণু জমি থেকে আসে এবং গুদামে রোগের অনুকূল পরিবেশে বিস্তার লাভ করে। আলুর গাছ জন্মানোর শুরু থেকেই রোগ দমন ব্যবস্খাপনা শুরু করা উচিত। এজন্য আগাম বীজ রোপণ, ফসল সংগ্রহ ও গুদামজাতকরণ। আলু হালকা রোদে বা ছায়ায় শুকিয়ে সংরক্ষণ করা উচিত।
শস্য বহুমুখীকরণ কর্মসূচির (সিডিপি) আওতায় আলু সংরক্ষণের ওই পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ ব্যাপারে যেকোনো পরামর্শের জন্য উপজেলা কৃষি অফিস এবং উপসহকারী কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
লেখক: ফরহাদ আহাম্মেদ কৃষিবিদ
তথ্যসূত্র: দৈনিক নয়াদিগন্ত

বিনা চাষে আলু আবাদ

বিনা চাষে আলু আবাদ

আলু

বিভিন্ন সময় মুন্সিগঞ্জসহ অন্যান্য জেলায় আলুর ফলন ভাল হওয়ায় বিভিন্ন এলাকায় কোল্ড-স্টোরেজ সংকটে পড়ে অনেক আলু নষ্ট হয়ে যায়। তারপর আবার সার, কীটনাশকসহ অন্যান্য উপকরণের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় চাষ খরচও বেড়ে গিয়েছে কয়েকগুণ। তবে খরচ কমিয়ে এই ফসল চাষ করার পদ্ধতিও আছে। এটি কৃষকের জন্য অনেক সাশ্রয়ী হবে, তেমনি অনেক পতিত জমিও চাষের আওতায় আসবে।

জোয়ার প্লাবিত দক্ষিণাঞ্চলে আমন ধান কাটার পর মাটি শুকাতে অনেক বেশি সময় নেয়ায় সঠিক সময়ে আলু চাষ করা কঠিন হয়ে পড়ে। দেরীতে আবাদের জন্য ফলনও অনেক কমে যায়। তাই যেসব এলাকা নীচু এবং বর্ষার পানি নামতে দেরী হয় সেখানে কৃষকরা বিনা চাষে আলু আবাদ করতে পারেন। এভাবে আবাদের ফলে চাষ খরচ অনেক কম যায় কারণ কচুরিপানার লাভজনক ব্যবহার হয়, একে মালচিং দ্রব্য হিসেবে ব্যবহার করে মাটির রস সবসময় সংরক্ষণ করা য়ায়, সেচ খরচ সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা যায়, অনেক কম রাসায়নিক সার দরকার হয়, জমিতে আগাছা কমে যায়, আলু বেশি সুস্বাদু হয় এবং এর আকারও অনেক বড় হয়।

এভাবে আলু চাষের জন্য এমন জমি নির্বাচন করতে হবে যেখানে বৃষ্টিপাত হলে পানি জমে না। সাধারণত উচ্চ ফলনশীল এবং স্থানীয় জাতের ধান কাটার পর জমি ফাঁকা হবার সঙ্গে সঙ্গেই আলু আবাদের সুযোগ ঘটে। কাছাকাছি নদী বা পুকুরে কচুরীপানার উৎস থাকতে হবে। নভেম্বর মাসের শেষ পর্যন্ত এ আলু চাষের উপযুক্ত সময়। তবে ডিসেম্বরের ১০ তারিখ পর্যন্ত বিরনা চাষ পদ্ধতিতে আলু আবাদ সম্ভব।

বীজ ব্যবস্থাপনা:
হিমাগারে সংরক্ষিত অনুমোদিত জাত যেমন- কার্ডিনাল, ডায়মন্ড ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রতি শতকে ৬-৮ কেজি বীজের দরকার হবে। ২৫-৩০ গ্রাম ওজনের ছোট আলু বা বড় আলুর কমপক্ষে দুই চোখ বিশিষ্ট কাটা অংশই আলুর বীজের জন্য ভাল। কাটা অংশে ছাই লাগিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। রোপণের আগে এসব বীজ অনুমোদিত ছত্রাকনাশক (যেমন-ব্যাভিস্টিন বা ডাইথেন এম-৪৫) দিয়ে শোধন করে নেয়া ভাল। ২০ ইঞ্চি দূরে সারি করে ১০ ইঞ্চি দূরে প্রতিটি বীজ আঙুলের চাপ দিয়ে বসিয়ে দিতে হবে। যদি মাটি কিছুটা শক্ত হয় তবে হাত লাঙল টেনে ১০ সেঃ মিঃ গভীর করে নালায় বসিয়ে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।

সার ব্যবস্থাপনা:
বীজ রোপণের আগে শতক প্রতি ১.৩ কেজি ইউরিয়া এবং আধা কেজি টিএসপি প্রয়োগ করতে হবে। বীজ রোপণের আগের দিন পটাশ ও গোবর সার একত্রে মিশিয়ে ছিঁটিয়ে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে বীজের গায়ে যেন কোনভাবেই রাসায়নিক সার না লাগে।

মালচিং বা আচ্ছাদন:
কচুরিপানা, খড়, নাড়া ইত্যাদি আচ্ছাদন হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। নদী বা খাল থেকে কচুরীপানা তুলে রেখে দিয়ে পানি ঝরিয়ে নিয়ে শুকালে সেটি আচ্ছাদন হিসেবে ভাল হয়। খড় বা নাড়াকে আচ্ছাদন হিসেবে ব্যবহার করলে ইঁদুরের আক্রমণ বাড়তে পারে। বীজ আলু লাগানোর পরপরই ৪-৬ ইঞ্চি পুরু করে আচ্ছাদন দিতে হবে। বীজ আলু সম্পূর্ণরূপে আচ্ছাদিত হতে হবে না হলে আলুর গায়ে সবুজ মেলানিনের দাগ পড়ে যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। আবার আচ্ছাদন বেশি হলে গাছ বের হতে সমস্যায় পড়ে।

রোগবালাই:
কাটুই পোকার কীড়া চারাগাছ কেটে দেয় এবং ছিদ্র করে ফসলের ক্ষতি করে। এই পোকা দিনের বেলা মাটির নীচে লুকিয়ে থাকে। এই পোকার উপদ্রব খুব বেশি না হলে কাটা গাছের কাছাকাছি মাটি খুঁড়ে কীড়া সংগ্রহ করে মেরে ফেলতে হবে। উপদ্রব বেশি হলে ক্লোরোপাইরিফস (ডারসবান) ২০ ইসি ৫ মিলি হারে মিশিয়ে গাছের গোড়া ও মাটি স্প্রে করে ভিজিয়ে দিতে হবে। আলু লাগানোর ৩০-৪০ দিন পর এটা করা দরকার। বাড়িতে সংরক্ষিত আলুতে সুতলী পোকা লম্বা সুড়ঙ্গ করে। পরে এটি অন্যান্য আলুর মধ্যেও ছড়িয়ে যায়। এজন্য বাড়িতে আলু সংরক্ষণের সময় ছাই, তুষ অথবা কাঠের গুঁড়ো দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। আলু সংরক্ষণের আগে আক্রান্ত আলু বাছাই করে ফেলে দিতে হবে। জাবপোকা গাছের রস চুষে খায় এবং ভাইরাস রোগ ছড়ায়। প্রতি ৭ দিন পর ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি ১০ মিলি ১০লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। উড়চুঙ্গা রাতে গর্ত থেকে বের হয়ে গাছের শেকড় ও কাণ্ড খেয়ে ফেলে। বিষটোপ ব্যবহার করে অথবা গর্ত থেকে পোকা বের করে মেরে ফেলতে হবে।

লেট ব্লাইট বা আলুর মড়ক রোগ হলে প্রথমে পাতা, ডগা ও কাণ্ডে ছোট ছোট ভেজা দাগ পড়ে। পড়ে এটি বড় হয়ে পুরো গাছে ছড়িয়ে পড়ে। বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা বেশি থাকলে ২-৩ দিনের মধ্যে পুরো ক্ষেতে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত ক্ষেতে পোড়া গন্ধ পাওয়া যায় যেন ফসল পুড়ে গিয়েছে। প্রতিকারের জন্য সুষম সার এবং সময়মত সেচ প্রয়োগ করতে হবে। রোগ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোভরাল অথবা ডাইথেন এম-৪৫, ২০ গ্রাম ১০ লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে।

এভাবে রোগবালাইয়ের হাত থেকে রক্ষা করে আবাদ করলে হেক্টর প্রতি ২৫-৩০ টন আলু ফলানো সম্ভব। আর স্বাভাবিকভাবে আলু চাষ করতে কৃষকের যে খরচ তাতে কৃষকের পুষিয়ে ওঠা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আর বিনাচাষে এই পদ্ধতিতে আলু চাষ করলে চাষ খরচ প্রায় তিন চতুর্থাংশে নেমে আসে।
লেখক: মাজহার মিলন
তথ্য সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক

আলু চাষে করণীয়

আলু চাষে করণীয়

আলু বাংলাদেশের একটি অন্যতম জনপ্রিয় সবজি। সেই সাথে অর্থকরী ফসলও। প্রতি বছর এ দেশে আলুর উৎপাদন যে পরিমাণে হিমাগারে রাখা যায় তার চেয়েও বেশি। তার পরও খাদ্য হিসেবে আলুর ব্যবহার দিন দিন এমনভাবে বেড়ে গেছে যে, বাজারে আলুর দাম কখনোই আর কম থাকছে না। সে জন্য প্রতি বছরই আলুর মৌসুম শুরুর আগে শুধু কৃষকরাই নয়, যারা কৃষি কাজের সাথে জড়িত নন এমন অনেকেই আলু চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েন। কারণ আলু চাষে স্বল্প সময়ে লাভ বেশি।

কিন্তু কিছু কিছু বিষয়ের প্রতি লক্ষ না রাখায় আলু চাষে অনেকেই কাংক্ষিত ফল বা ফলন পান না। তখন বিভিন্ন জনকে বিভিন্নভাবে দোষারোপ করেন। তাই আলু চাষে নামার আগে থেকেই যদি কয়েকটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয় তাহলে আলুর কাংক্ষিত ফলন পাওয়া সম্ভব হতে পারে।

প্রথমেই জমি নির্বাচন। বেলে বা বেলে দো-আঁশ মাটিতে আলু ভালো হয়। সূর্যের আলো প্রচুর পড়ে এমন উঁচু বা মাঝারি উঁচু জমি আলু চাষের জন্য নির্বাচন করা উচিত। জমিতে পানি সেচ দেয়া ও পানি নিষ্কাশনের উপযুক্ত ব্যবস্খা থাকাও প্রয়োজন। এ জন্য জমি সমতল করতে হয়। যেহেতু আলু মাটির নিচের ফসল, তাই জমি গভীর চাষ দিতে হয়। জমি চাষ দেয়ার পর ৭ থেকে ১৫ দিন রোদে ফেলে শুকিয়ে নিতে হয়। এতে মাটির নিচে থাকা বিভিন্ন পোকা, পোকার কিড়া ও পুত্তলী এবং রোগজীবাণু রোদের আলো ও তাপের সংস্পর্শে এসে নষ্ট হয়। আড়াআড়ি চাষ দিয়ে মাটি এমনভাবে চিকন ও ঝুরঝুরে করতে হয় যেন মাটির মধ্যে বাতাস চলাচল ভালোভাবে করতে পারে, যাতে আলুর টিউবার গঠন কাজটি সহজ হয়। চাষের শেষে জমির সব আগাছা ও আগের ফসলের অবশিষ্টাংশ সংগ্রহ করে দূরে কোথাও পুঁতে বা পুড়িয়ে ফেলতে হয়।

তবে জমি তৈরির আগে মাটি শোধন করে নিতে পারলে ভালো হয়। এতে আলুর ঢলে পড়া রোগ প্রতিরোধ করা যায়। আগের বছর ঢলে পড়া রোগ হয়নি বা রোগ হয়েছে এমন যেকোনো জমিতেই মাটি শোধন করে নিতে হয়। শেষ চাষের আগে বিঘা প্রতি ৪ থেকে ৫ কেজি ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে চাষ দিয়ে সেচ দিতে হয়। ব্লিচিং পাউডার জমির মাটির সাথে মেশানোর পর জমিতে অবশ্যই জো অবস্খা থাকতে হয়। এভাবে ২৮ থেকে ৩০ দিন জমি ফেলে রাখতে হয়। এতে জমির মাটি শোধন হয় অর্থাৎ মাটির বিশেষ বিশেষ রোগ জীবাণু ধ্বংস হয় বা তাদের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।

জানা উৎস বা বিশ্বস্ত কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে আলুবীজ সংগ্রহ করতে হয়। বীজ আলু যদি খারাপ হয় তাহলে আলু চাষের সব আয়োজনই বিফলে যেতে বাধ্য। তাই যেনতেন জায়গা বা যে কারো কাছ থেকে বীজআলু সংগ্রহ না করে এমন উৎস থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হয় যেন আলুর বীজ খারাপ হলে তার জন্য জবাবদিহিতা থাকে।

বীজ সংগ্রহের পর বীজ শোধন করতে হয়। এ জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্খা না করলেও চলে। যেমন কেউ কেউ কার্বেন্ডাজিম জাতীয় ছত্রাকনাশক ব্যবহার করে থাকেন। এ জাতীয় ছত্রাকনাশক বীজ আলু শোধনে ব্যবহার করলে ১ গ্রাম ছত্রাকনাশক ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১ কেজি কাটা বীজ আলু ৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখলে বীজবাহিত ছত্রাকঘটিত রোগজীবাণু ধ্বংস হয়। আলুর ঢলে পড়া ও গোড়া পচা রোগ প্রতিরোধে প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে স্ট্রেপটোমাইসিন মিশ্রিত করতে হয়। বীজ আলু সংগ্রহের পর কাটার আগে আলো-বাতাস চলাচল করে এমন পরিষ্কার সমতল জায়গায় বস্তা খুলে আলু বের করে এক থেকে দেড় ফুট উঁচু স্তূপ বা হিপ করে ছড়িয়ে রাখতে হয়। মাঝে মধ্যে ওলটপালট করতে হয়।

বীজআলু শুধু লম্বালম্বি এমনভাবে দু’ভাগ করে সমভাবে কাটতে হয়, যাতে কর্তিত দু’অংশে কমপক্ষে দুটি করে চোখ থাকে। এই অংশের ওজন ২৫ থেকে ৩০ গ্রাম এবং ৩ থেকে ৪ সেন্টিমিটার ব্যাসবিশিষ্ট হতে হয়। অনেকেই চোখের সাথে আলুর অংশ কম রেখে বাকিটুকু খাবার হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন, এটা ঠিক নয়। কর্তিত অংশের সাথে যতটুকুই থাকুক সবটুকুই রাখতে হয়। বীজ কাটার সময় চাকু বা বঁটির দুই পাশ জীবাণুনাশকে ভেজানো কাপড়ের টুকরো দিয়ে মাঝে মধ্যে মুছে নিতে হয় যেন রোগজীবাণু এক আলু থেকে অন্য আলুতে ছড়াতে না পারে। আলুর কাটা অংশ উপরের দিকে করে মাটিতে ছড়িয়ে বিছিয়ে রাখতে হয়। কখনোই গাদাগাদি করে রাখা উচিত নয়। রাখার স্খানে আলো এবং বাতাস চলাচলব্যবস্খা থাকতে হয়। এভাবে ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টা রেখে দিলে কাটা অংশের ওপরে একটি শক্ত কালচে ধরনের স্তর পড়ে, যাকে সোবারাইজেশন বলে। এই অংশ ভেদ করে কোনো রোগজীবাণু ঢুকতে পারে না। কাটা অংশে ছাই ব্যবহার করা যেতে পারে, তাতে অতিরিক্ত হিসেবে পটাশিয়াম সরবরাহ করা হয়। আবার পোকার বিকর্ষক হিসেবেও এটি কাজ করে।

আলু রোপণের উপযুক্ত সময় হলো নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শেষ পর্যন্ত। দিন পেছালে শীতে গাছের বৃদ্ধি কমে, গাছ খুব বেশি বড় হওয়ার আগেই টিউবার গঠন কাজ শুরু হয়ে যায়। এতে টিউবার সংখ্যা কমে যায়। শীতে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের টিউবার গঠন ভালো হয়। ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত আলুবীজ রোপণ করা যায়, তবে ফলনও আনুপাতিক হারে কমে যায়।

আলু চাষে কম্পোস্ট সার ব্যবহার না করা ভালো। কারণ যেসব কম্পোস্টের উপাদান হিসেবে শাকসবজির উচ্ছিষ্টাংশ বা গাছ-গাছড়ার বা যেকোনো জৈব জিনিসের পচনশীল অংশ ব্যবহার করা হয় সেসবের সাথে ঢলে পড়া রোগের রোগজীবাণু থাকতে পারে, যা এই রোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। এ জন্য কম্পোস্টের পরিবর্তে ভালোভাবে পচানো শুকনো গোবর সারই জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা ভালো। সবচেয়ে ভালো হয় বায়োগ্যাস প্লান্ট থেকে সংগ্রহ করা শুকনো সার।

আলু চাষে একর প্রতি ইউরিয়া ১১২ কেজি, টিএসপি ৭৫ কেজি, এমওপি ১১২ কেজি, জিপসাম ৪০ কেজি, জিংক সালফেট ৫ কেজি এবং বোরণ সার ৪ কেজি ব্যবহার করতে হয়। অর্ধেক ইউরিয়া, অর্ধেক এমওপি ও সম্পূর্ণ টিএসপি এক সাথে মিশিয়ে বীজ আলু বপনের পাশে সারের নালায় দিতে হয়। বাকি সার রোপণের ৩৫ থেকে ৪০ দিনের মধ্যে উপরি প্রয়োগ করতে হয়। আর জিপসাম, জিংক সালফেট এবং বোরণ সার শেষ চাষের সময় ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়। যেসব অঞ্চলের মাটিতে ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতি আছে সেসব অঞ্চলে ম্যাগনেশিয়াম সার শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হয়।

উপরি সার প্রয়োগের পর আলুর সারিতে বা গাছের গোড়ায় উঁচু করে (প্রায় ২০ সেন্টিমিটার) মাটি তুলে দিতে হয়। ভেলির গোড়া চওড়া রাখার জন্য ১৫ সেন্টিমিটার প্রস্খের ছোট কোদাল ব্যবহার করতে হয়। মাটি তোলার সময় লক্ষ্য রাখতে হয় যেন কোদালের সাথে প্রয়োগকৃত সার উঠে না আসে।

আলু চাষে সেচ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রোপণের সময় জমির জো অবস্খা থাকতে হয় এবং রোপণের পর ১ থেকে ২টি গাছ যখন মাটির ওপরে উঠে আসে তখন প্রথমবার সার উপরি প্রয়োগের পর একটি হালকা সেচ দিতে হয়। এটি সাধারণত রোপণের ৭ দিনের মধ্যে দিতে হয়। এবপর মাটির প্রকার ও প্রয়োজন অনুযায়ী ৩ থেকে ৫ বার সেচ দিতে হয়। তবে টিউবার গঠনের শুরুর সময় অর্থাৎ ৪০ থেকে ৪৫ দিনের সময় মাটিতে রস না থাকলে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে বা ফলন কমে যেতে পারে। সুষম সেচের জন্য তাই নিয়মিত জমি পরিদর্শন করতে হয়।

খাবার আলু ৯৮ থেকে ১২০ দিনের মধ্যে সংগ্রহ করা যায়। আর বীজ আলু ৭২ থেকে ৭৫ দিন পর গাছ তুলে রেখে ৮০ থেকে ৮৫ দিনের মধ্যে ক্ষেত থেকে তুলতে হয়। জাত ভেদে বাংলাদেশে আলুর ফলন একর প্রতি ৭ থেকে ১০ টন পর্যন্ত হয়ে থাকে।
লেখক: খোন্দকার মো: মেসবাহুল ইসলাম

আমের ভালো ফলন পেতে রোগ-বালাই প্রতিকার

আমের ভালো ফলন পেতে রোগ-বালাই প্রতিকার

পাক-ভারত উপমহাদেশে আম সবচেয়ে জনপ্রিয় ফল। এ জন্য আমকে বলা হয় ফলের রাজা। রাজা হলেও বেড়ে ওঠার সময় অন্যান্য ফলের মতো তাকেও নানা সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়। এসব সমস্যার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণই প্রধান। সঠিক সময়ে রোগ ও পোকামাকড় দমন করতে ব্যর্থ হলে আমের ফলন অনেক কমে যায়। তবে এসব রোগ ও পোকামাকড় দমনের জন্য সঠিক বালাইনাশক বা ছত্রাকনাশক সঠিক মাত্রায়, সঠিক সময়ে, সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে ব্যবহার করলে আমের ফলন কমে যাওয়ার আশঙ্কা অনেকটাই কমে যায়। আমের ভালো ফলন পাওয়ার জন্য পরিচর্যা শুরু করতে হবে আমবাগানে মুকুল বের হওয়ার আগেই। গাছে মুকুল আসার কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ দিন আগে পুরো গাছ সাইপারমেথ্রিন বা কার্বারিল গ্রুপের যেকোনো কীটনাশক দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে দিতে হবে। তাহলে গাছে বাস করা হপার বা শোষকজাতীয় পোকাসহ অন্যান্য পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। যদি সঠিক সময়ে হপার বা শোষক পোকা দমন করা না যায় তাহলে আমের ফলন কমে যেতে পারে। এমনটি হওয়ার কারণ হলো হপার বা শোষক পোকা আমগাছের কচি অংশের রস চুষে খেয়ে বেঁচে থাকে। আমের মুকুল বের হওয়ার সাথে সাথে এরা মুকুলকে আক্রমণ করে আমের মুকুল থেকে রস চুষে খেয়ে ফেলে। ফলে মুকুল শুকিয়ে ঝরে পড়ে। একটি হপার পোকা দৈনিক তার দেহের ওজনের ২০ গুণ রস শোষণ করে খায় এবং দেহের প্রয়োজনের অতিরিক্ত আঠালো রস মলদ্বার দিয়ে বের করে দেয়, যা মধুরস বা হানিডিউ নামে পরিচিত। এ মধুরস মুকুলের ফুল ও গাছের পাতায় জমা হতে থাকে। মধুরসে এক প্রকার ছত্রাক জন্মায়। এই ছত্রাক জন্মানোর কারণে মুকুল, ফুল ও পাতার ওপর কালো রঙের স্তর পড়ে; যা সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। এই পোকার আক্রমণে শুধু আমের উৎপাদনই কমে যায় না, গাছের বৃদ্ধিও কমে যেতে পারে।

হপার পোকা দমন : আমের ফলন ভালো পেতে হলে অবশ্যই হপার পোকা দমন করতে হবে। হপার পোকা অìধকার বা বেশি ছায়াযুক্ত স্খান পছন্দ করে। তাই নিয়মিতভাবে গাছের ডালপালা ছাঁটাই করতে হবে, যাতে গাছের মধ্যে আলো-বাতাস প্রবেশ করতে পারে।
আমের মুকুল যখন ৩ থেকে ৪ সেন্টিমিটার লম্বা হয় তখন একবার এবং আম যখন মটর দানার মতো আকার ধারণ করে তখন আরেকবার প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলিলিটার হারে সাইপারমেথ্রিন (রিপকর্ড বা সিমবুস বা ফেনম বা এরিভো) ১০ ইসি মিশিয়ে পুরো গাছে স্প্রে করতে হবে।
আমের হপার পোকার কারণে যেহেতু সুটিমোল্ড বা ঝুল রোগের আক্রমণ ঘটে তাই রোগ দমনের জন্য প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে সালফারজাতীয় ছত্রাকনাশক হপার পোকা দমনের জন্য ব্যবহার করা কীটনাশকের সাথে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

পাউডারি মিলডিউ : পাউডারি মিলডিউ এক ধরনের মারাত্মক রোগ। আমাদের দেশে এ রোগের আক্রমণ প্রতি বছর দেখা না গেলেও কোনো কোনো বছর অনুকূল আবহাওয়া বিরাজ করলে রোগটি মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে।
পাউডারি মিলডিউ রোগের আক্রমণ প্রধানত আমের মুকুল ও কচি আমে প্রকাশ পায়। প্রথমে আমের মুকুলের শীর্ষ প্রান্তে সাদা বা ধূসর বর্ণের পাউডারের আবরণ দেখা যায়। কচি পাতাতেও রোগের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এই পাউডার হচ্ছে ছত্রাক ও তার বীজকণার সমষ্টি। হালকা বৃষ্টি, মেঘলা বা কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশ এ রোগের জীবাণুর ব্যাপক উৎপাদনে সহায়তা করে। অনুকূল আবহাওয়ায় এই পাউডার সম্পূর্র্ণ মুকুলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত মুকুলের সব ফুল নষ্ট হয়ে যায়। এ অবস্খায় শুধু মুকুলের দণ্ডটি দাঁড়িয়ে থাকে। আক্রমণ মারাত্মক হলে গাছে কোনো ফল ধরে না। তা ছাড়া বেশি আক্রান্ত কচি আম ঝরে পড়ে।

প্রতিকারের উপায় : মুকুল আসার সময় প্রতিদিন (বিশেষ করে মেঘলা আবহাওয়াযুক্ত দিনে) আমগাছ পর্যবেক্ষণ করতে হবে মুকুলে পাউডারি মিলডিউ রোগ দেখা দিয়েছে কি না। রোগের লক্ষণ দেখা দিলেই সালফার বা গìধকযুক্ত যেকোনো ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে।

ফলের মাছি পোকা :আমের ভালো ফলন পেতে হলে বাগান ব্যবস্খাপনার দিকে নজর দেয়া জরুরি। বাগান ব্যবস্খাপনা সঠিক না হলে ফলন আশানুরূপ না হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এখন দেশের সব এলাকার আমগাছে থোকা থোকা কাঁচা আম শোভা পাচ্ছে। সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে এমন আম দেখে চাষি ভাইদের সুখের ঢেকুর তোলার সুযোগ নেই। কারণ আম ঘরে আসতে এখনো অনেক প্রতিকূল পরিবেশ পাড়ি দিতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ফলের মাছিপোকা। হ্যাঁ, ফলের এই মাছি পোকাই আপনার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। আমের বয়স দুই মাস থেকে আম সংগ্রহ করা পর্যন্ত এ পোকা আমের ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে। বাজারে ভালো দামে আম বিক্রির ক্ষেত্রে এটা বড় সমস্যা। যারা ব্যাপক আকারে আম চাষ করেন তাদের জন্য এটা আরো বড় সমস্যা। কারণ তারা উৎপাদিত আমের বেশির ভাগই রফতানি করেন। পোকায় খাওয়া আম দেশেই বিক্রি করা কঠিন, রফতানি করা তো দূরের কথা।

মাছিপোকা আক্রমণের প্রাথমিক অবস্খায় বাইরে থেকে বোঝা যায় না। আম পাকার মৌসুমে স্ত্রী মাছি পরিপক্ব আমের গায়ে ডিম পাড়ে। ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে সাদা কিড়া বের হয়। এ অবস্খায় পাকা আম নরম হয়ে গেলে ম্যাগোট আম থেকে বের হয়ে মাটির গর্তে ঢুকে যায় এবং ছয় দিন পর এটি পুত্তলিতে পরিণত হয়। পুত্তলিতে পরিণত হওয়ার ছয় দিন পর এটি পূর্ণাঙ্গ মাছিপোকায় রূপান্তরিত হয়। প্রাথমিক অবস্খায় মাছিপোকার আক্রমণ বুঝা য়ায় না, তবে ভালোভাবে লক্ষ করলে আক্রান্ত আমের গায়ে ডিম পাড়ার স্খানে ক্ষুদ্র ক্ষতচিহ্ন দেখা যায়। ক্ষত স্খানটি কিছুটা বিবর্ণ হয়ে যায়। আক্রান্ত আম পাকা শুরু হলে আক্রান্ত স্খান থেকে রস ঝরতে দেখা যায়। পাকা আম কাটলে আক্রান্ত আমের শাঁসের ভেতর ১০০ থেকে ১৫০টি সাদা সাদা পোকার কিড়া দেখা যায়। এ পোকায় আক্রান্ত আম অনেক সময় বিকৃত হয়ে যায় বা পচে যায়। এই মৌসুমে মাছিপোকার মাধ্যমে ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি। কারণ উচ্চতাপমাত্রা ও মাঝে মধ্যে বৃষ্টি হলে মাছিপোকা তাড়াতাড়ি বড় হয়।

প্রতিকারের উপায় :আম গুটি বাঁধার ৫০ থেকে ৫৫ দিন পর প্রতিটি আম কাগজ (ব্রাউন পেপার) দিয়ে মুড়িয়ে দিলে আমকে পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা করা যায়। ছোট গাছের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি সহজেই ব্যবহার করা যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা আমের রসের সাথে এক গ্রাম ডিপটেরেক্স মিশিয়ে বিষটোপ বানিয়ে এ বিষটোপ বাগানে রেখে মাছি পোকা দমন করা যেতে পারে। আম পাকার মৌসুমে আমবাগানে ব্লিচিং পাউডার (প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম) স্প্রে করে মাছি তাড়ানো যেতে পারে। আম পাকার মৌসুমে প্রতিটি আম কাগজ (ব্রাউন পেপার) দিয়ে মুড়িয়ে দিলে আমকে পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা করা যাবে। আমবাগানে ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করা যেতে পারে।

পরগাছা উদ্ভিদ : আমাদের দেশে আমগাছে দু-তিন প্রকার পরগাছা উদ্ভিদ জন্মাতে দেখা যায়। স্খানীয়ভাবে পরগাছা উদ্ভিদ ধ্যারা নামে পরিচিত। ছোট গাছের চেয়ে বড় বা বয়স্ক আমগাছে পরগাছার আক্রমণ বেশি হয়। পরগাছা উদ্ভিদের বীজ আমগাছের ডালে অঙ্কুরিত হয়ে বাড়তে থাকে। পরগাছা ডাল থেকে প্রয়োজনীয় পানি, খাদ্যরস, খনিজ পদার্থ ইত্যাদি শোষণ করে বেঁচে থাকে। পরগাছার শিকড় থাকে না, তারা শিকড়ের মতো এক প্রকার হস্টোরিয়া তৈরি করে। হস্টোরিয়া গাছের ডালে প্রবেশ করে ডাল থেকে খাদ্য গ্রহণ করে। আক্রান্ত ডালের প্রায় সব খাবার পরগাছা খেয়ে ফেলে। ফলে আক্রান্ত ডাল দুর্বল হয়ে পড়ে। আক্রমণ বেশি হলে আম ডালের অস্তিত্ব থাকে না বরং পরগাছা প্রভাব বিস্তার করে বাড়তে থাকে। লরানথাসজাতীয় পরগাছার পাতা দেখতে কিছুটা আমপাতার মতোই। তাই ভালোভাবে লক্ষ না করলে দূর থেকে পরগাছার উপস্খিতি বোঝা যায় না। তবে পরগাছায় ফুল ও ফল ধরলে দূর থেকে পরগাছার উপস্খিতি বোঝা যায়। এ সময় পরগাছা ফুল ফুটন্ত অবস্খায় থাকে। ফলে সহজেই শনাক্ত করা যায়। পরগাছা আকর্ষণীয় ফুল ও ফল উৎপন্ন করে। বীজসহ ফল পাখিরা খায়, কিন্তু বীজ হজম না হওয়ায় তা মলের সাথে বের হয়ে আসে। এ বীজ আমের ডালে পতিত হয়ে অঙ্কুরিত হয় ও বাড়তে থাকে। বর্ষাকালে পরগাছার বীজ বিস্তার লাভ করে।

প্রতিকারের উপায় : আক্রান্ত ডাল পরগাছার গোড়াসহ কেটে ফেলতে হবে। কাটা স্খানে রোগের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য বোর্দো পেস্টের প্রলেপ দিতে হবে। পরগাছায় ফুল-ফল আসার আগেই পরগাছা ছাঁটাই করা উচিত।

ওপরে যেসব সমস্যার কথা বলা হলো আম চাষে কেবল এরাই সমস্যা তৈরি করে, তা নয়। আরো অনেক সমস্যা আছে। সঠিক সময়ে এসব সমস্যার সমাধান করতে পারলে আমের ভালো ফলন পাওয়া যায়। যারা আম চাষ করতে গিয়ে নানা সমস্যায় পড়ছেন বা পড়েছেন তারা সঠিক পরামর্শের জন্য ০৭৮১-৫৫৪৭২ অথবা ০১৭১২১৫৭৯৮৯ নম্বরে যোগাযোগ করতে পারেন।

আমের মহালাগা : কারণ ও করণীয়

আম বাংলাদেশের প্রধান চাষযোগ্য অর্থকরী ফলগুলোর অন্যতম হলেও আম চাষে রয়েছে নানা সমস্যা। তারমধ্যে বিভিন্ন রোগ ও পোকা-মাকড়ের আক্রমণ উল্লেখযোগ্য। সঠিক সময়ে রোগ ও পোকা-মাকড় দমন করতে ব্যর্থ হলে আমের ফলন মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। এই রোগ ও পোকা-মাকড় দমনের সঠিক বালাইনাশক নির্বাচন করে নির্দিষ্ট মাত্রায় সঠিক সময়ে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়। আম বাগানে মুকুল বা পুস্পমঞ্জুরী বের হওয়ার আনুমানিক ১৫-২০ দিন আগে সাইপারমেথ্রিন, কার্বারিল, ইমিডাক্লোরোপিড, সাইহ্যালাথ্রিন গ্রুপের যে কোনো কীটনাশক দিয়ে ভালভাবে সমস্ত গাছে স্প্রে করে দিতে হবে। সেক্ষেত্রে গাছে বসবাসকারী হপার বা শোষক পোকাসহ অন্যান্য পোকার আক্রমণ হবে না। যদি সঠিক সময়ে হপার পোকা দমন করা না যায় তাহলে আমের মুকুল বের হওয়ার সাথে সাথে এগুলো মুকুলকে আক্রমণ করে। এই পোকার আমের মুকুল থেকে রস চুসে খায় ফলে মুকুল শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে যায়। পরে শুধু গাছে আম শূন্য মুকুল দেখা যায়। একটি হপার পোকা দৈনিক তার দেহের ওজনের ২০গুন পরিমাণ রস খায় এবং দেহের প্রয়োজনের অতিরিক্ত আঠালো রস মলদ্বার দিয়ে বের করে যা মধুরস নামে পরিচিত। এ মধুরস মুকুলের ফুল ও গাছের পাতায় জমা হয়। পরে এ থেকে জন্ম নেয় এক প্রকার ছত্রাক। এর ফলে মুকুল, ফুল ও পাতার উপর কালো রংয়ের স্তর পড়ে যা সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। ছত্রাকের এ আক্রমণকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় স্থানীয়ভাবে মহালাগা বলে। চলতি মৌসুমে বৃষ্টি হওয়ার পর এই ছত্রাকের আক্রমণ সেখানে ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে এর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এই অবস্থা চলতে থাকলে অন্যান্য এলাকাতেও এর বিস্তার ঘটে। তবে বৃষ্টি হওয়া মাত্রই এর আক্রমণ কমবে। এই পোকার আক্রমণে আমের উৎপাদন শতকরা ১০০ ভাগ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে এবং গাছের বৃদ্ধি কমে যেতে পারে।

দমন পদ্ধতি : ১. হপার পোকা অন্ধকার বা বেশি ছায়াযুক্ত স্থান পছন্দ করে তাই নিয়মিতভাবে গাছের ডালপালা ছাঁটাই করতে হবে যাতে গাছের মধ্যে আলো বাতাস প্রবেশ করতে পারে।

২. আমের মুকুল যখন ৮ থেকে ১০ সে. মি. হয় অর্থাৎ ফুল ফোটার আগে একবার এবং আম যখন মটর দানাকৃতি হয় তখন আর একবার প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি লিটার হারে সাইপারমেথ্রিন ১০ইসি, ডেসিস ২.৫ইসি, কার্বারিল, ইমিডাক্লোরোপিড, সাইহ্যালাথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক ভালভাবে মিশিয়ে সম্পূর্ণ গাছ স্প্রে করতে হবে।

৩. আমের হপার পোকার কারণে সুটিমোল্ড বা ঝুল রোগের আক্রমণ ঘটে। রোগ দমনের জন্য প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে সালফার জাতীয় ছত্রাকনাশক হপার পোকা দমনের জন্য ব্যবহার্য কীটনাশকের সাথে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
লেখক: মো: শরফ উদ্দিন কৃষিবিদ

কাঁঠালের মুকুলঝরা সমস্যা ও সমাধান

কাঁঠালের মুকুলঝরা সমস্যা ও সমাধান

গরীবের আমিষ ও জাতীয় ফল কাঁঠালের মুকুলঝরা সমস্যাটি বড় সমস্যা। এর কারণে কাঁঠাল ঝরে পড়ায় ফলন মারাতক কমে। মুকুল আসার সময় একটু সচেতন হলেই মুকুল ঝরা কমানো যায়। এজন্য যে বিষয় গুলো জানতে হবে--
পুষ্টিহীনতাঃ
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য উদ্ভিদের ১৭টি পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন। এর যেকোনো একটির অভাব কিংবা পরিমান বেশী হলে কাঁঠালগাছ পুষ্টিহীনতায় ভোগে। কাঁঠাল গাছের পুষ্টি নিশ্চত করতে বর্ষার আগে একবার, বর্ষার পরে একবার এবং মুকুল আসার সময় আরেকবার সার দিতে হয়। এজন্য ঠিক দুপুরে গাছের ছায়া যতটুকু স্থান দখল করে ততটুকু স্থান কুপিয়ে সার ছিটিয়ে সেচ দিতে হয়। এছাড়া সেচ দিতে হয় নিয়মিত।

সারঃ
বর্ষার আগে ও পরে প্রতিবারে ষোল বছরের বেশী বয়সের কাঁঠাল গাছের জন্য নব্বই থেকে ১০০ কেজি গোবর, দেড় থেকে দুই কেজি ইউরিয়া, এক থেকে দেড় কেজি করে টিএসপি ও এমপি সার দিতে হয়। মুকুল আসার সময় যেকোনো বয়সের গাছের জন্য ২০০ গ্রাম করে ইউরিয়া, টিএসপি ও এমপি সার দিতে হয়। এতে মুকুলঝরা কমে যায়।

সেচঃ
প্রত্যেকবার সার ছিটানোর পর সেচ দিতে হয়। শুস্ক মৌসুমে প্রতিদিন নিয়মিত সেচ দিলে গাছের মুকুলঝরা কমে, কাঁঠালের বোঁটা শক্ত হয়, ফল রসালো হয়, রোগবালাইও হয় কম। ফলন হয় বেশি।
প্রতিদিন সেচ দেওয়ার জন্য কাঁঠাল গাছের গোড়ার চারপাশে মাটি দিয়ে আইল তৈরি করে গোলাকার আইলের মধ্যে পানি ঢেলে সেচ দিতে হয়।

কাঁঠালের পোকামাকড়ঃ
কাঠাঁল গাছের বাকলের মাজরা পোকা ও মুকুলের মাজরা পোকা প্রধান। মুকুলের মাজরা পোকা কচি কাগু, ফুলের কুড়ি ও বেড়ে ওঠা ফলের গায়ে গর্ত করে ভেতরে ঢুকে,সেখান থেকে খাদ্য গ্রহণ করে। এতে আক্রান্ত কান্ড দুর্বল হয়ে পড়ে ও কুঁিড়গুলো শুকিয়ে মরে যেতে থাকে।
বাকলের মাজরা পোকা রাতে গাছের বাকল বা ছাল খায়। খাওয়া অংশ নরম আশেঁর মতো দেখায়।। আশেঁর ভেতর দিয়ে পোকাগুলো কাগেু ছোট ছোট সুড়ঙ্গ তৈরি করে ভেতরে ঢুকে। এতে গাছের বৃদ্ধি কমে যায়। কাঁঠালের উৎপাদনও কম হয়।

পোকামাকড় দমনঃ
মুকুলের মাজরা পোকা দমনের জন্য ১০ লিটার পানিতে ৩০ মিলি এবং বাকলের মাজরা পোকার জন্য ৩৫ মিলি ডায়াজিনন-৬০ ইসি মিশিয়ে ২১ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে।

কাঁঠালের রোগঃ
ছত্রাকের কারণে কাঁঠালের মুকুল পচাঁ রোগটিই মুকুল ঝরার প্রধান সমস্যা। আক্রান্ত মুকুল প্রথম দিকে ধূসর দেখায়, পরে মুকুলের গায়ে সরু ও লম্বা সাদা ছত্রাক দেখা যায। আক্রান্ত মুকুল শেষে মাটিতে ঝরে পড়ে।
গাছে মুকুল আসার পর মুকুল পচাঁ রোগ দেখার সাথে সাথে ডায়থেন এম-৪৫ ওষুধটির চার গ্রাম এক লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

হরমোন প্রয়োগঃ
নিয়মিত সেচ, মুকুল আসার পর সার দেওয়া, রোগ ও পোকামাকড় দমনে ওষুধ প্রয়োগের পরও যদি মুকুল ঝরে পড়ে তাহলে গাছে ষ্টিমুলেট নামের হরমোন দিতে হবে। এতে স্ত্রী মুকুল বেশি টিকে থাকায় মুকুল ঝরে পড়ে না। কাঁঠালের মুকুলঝরা রোধের জন্য ষ্টিমুলেট হরমোনটি প্রতি লিটার পানিতে তিন মিলি মিশিয়ে মুকুলে স্প্রে করে দিতে হবে দুই থেকে তিনবার।
লেখক: সিদ্দিকুর রহমান শাহীন

আমের গুটি ঝরা ও এর সমাধান

আমের গুটি ঝরা ও এর সমাধান

আম চাষ করতে গিয়ে আমচাষিরা মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন সমস্যায় পড়েন। এসব সমস্যার মধ্যে আমের গুটি ঝরা অন্যতম। আমগাছে গুটি আসার পর নানা কারণে গুটি ঝরে যায়। এসবের কারণ ও তার প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করা হলো :

প্রাকৃতিক কারণ :
সাধারণত আমগাছে প্রতি মুকুলে এক হাজার থেকে ছয় হাজার পর্যন্ত পুরুষ ও স্ত্রী ফুল থাকে। তার মধ্যে প্রাথমিকভাবে প্রতি থোকায় জাতভেদে এক থেকে ৩০টি আমের গুটি ধরতে দেখা যায়। গুটি আসার ২৫ থেকে ৫০ দিনের মধ্যে প্রতি থোকায় মাত্র এক থেকে দু’টি গুটি থাকে। বাকি গুটি প্রাকৃতিক বা অভ্যন্তরীণ কারণে ঝরে যায়। তবে কোনো কোনো মুকুলে কদাচিৎ চার থেকে পাঁচটি আম ধরতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে আমের আকার ছোট হয়।

প্রতিকার :
অতিরিক্ত গুটি ঝরে না পড়লে আমের আকার ছোট হয় এবং আমের গুণগত মান ও ফলন কমে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিটি মুকুলে একটি করে গুটি থাকলে সে বছর আমের বাম্পার ফলন হয়। তবে প্রতি মুকুলে আমের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য ফুল ফোটার ১০ ও ২০ দিন পর দুইবার ১০ লিটার পানিতে ৬ গ্রাম হারে বোরিক অ্যাসিড স্প্রে করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সব ফুল ফোটা অবস্খায় জিবেরেলিক অ্যাসিড প্রতি লিটার পানিতে ৫০ মিলিগ্রাম হারে স্প্রে করলে আমের গুটি ঝরা কমে যায়।

মাটিতে রসের অভাব হলে : মাটিতে রসের অভাব হলেও আমের গুটি ঝরে যায়। আমের বৃদ্ধির প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থাৎ মার্চ-এপ্রিল মাসে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় মাটিতে রসের অভাব দেখা দেয়। মাটিতে রসের অভাব হলে আমের বোঁটায় তাড়াতাড়ি নির্মোচন স্তর গঠিত হয়। ফলে আমের গুটি ঝরে যায়।

প্রতিকার : মাটিতে রসের অভাবে আমের গুটি ঝরে গেলে গাছের চার পাশে নিয়মিত সেচ দিতে হবে। আমের গুটি মটরদানার মতো হলেই প্রথমে একবার গাছের গোড়ায় পানি সেচ দিতে হবে। প্রথম সেচ দেয়ার পর থেকে বৃষ্টিপাত না হওয়া পর্যন্ত ১৫ দিন পরপর সেচ দিতে হবে। সেচের পাশাপাশি হরমোন প্রয়োগ করেও আমের গুটি ঝরা কমানো যায়। যেমনন্ধ আমের গুটি মটরদানার মতো হলে প্রতি লিটার পানিতে ২০ গ্রাম ইউরিয়া সার অথবা প্রতি ৪.৫ লিটার পানিতে দুই মিলিলিটার হারে প্লানোফিক্স হরমোন পানিতে মিশিয়ে হালকা সূর্যের আলোয় আমের গুটিতে স্প্রে করলে গুটি ঝরা কমে যায়।

পোকার আক্রমণ হলে : গুটি আসার পর প্রাথমিক পর্যায়ে আমের গুটিতে হপার পোকার আক্রমণ হতে পারে। এ পোকার পূর্ণবয়স্ক মথ ও কীড়া গুটির রস শোষণ করে খায়, ফলে আমের গুটি শুকিয়ে ঝরে যায়। প্রতিকার : রোগ-পোকা থেকে আমের গুটি রক্ষার জন্য গুটি মটরদানার মতো হলেই কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক একসাথে পানিতে মিশিয়ে গুটিতে স্প্রে করতে হবে। কীটনাশকের মধ্যে সাইপরমেথ্রিন ১০ ইসি বা ল্যামডা সাই হ্যালাথ্রিন ২.৫ ইসি বা ফেন ভেলারেট ২০ ইসি গ্রুপের যেকোনো একটি কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে এক মিলিলিটার হারে এবং ছত্রাকনাশকের মধ্যে মেনকোজেব ৮০ ডচ গ্রুপের যেকোনো একটি প্রতি লিটার পানিতে দুই গ্রাম হারে একসাথে মিশিয়ে গুটিতে স্প্রে করতে হবে।
আমের গুটি মার্বেল আকৃতির হলে ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ হতে পরে। এ ক্ষেত্রে পূর্ণবয়স্ক পোকা আমের নিচের অংশে খোসার ওপরে ডিম পাড়ে। কয়েক দিনের মধ্যে ডিম ফুটে লার্ভা বের হয় এবং লার্ভা খুব ছোট বিন্দুর মতো ছিদ্র করে আমের ভেতর ঢুকে পড়ে। প্রথমে শাঁস ও পরে আঁটি খাওয়া শুরু করে। পরে আক্রান্ত স্খান কালো হয়ে যায় এবং কোনো কোনো সময় আম ঝরে পড়ে।

প্রতিকার : আমবাগান পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। মরা ডালপালা ছেঁটে ফেলতে হবে।
লেখক: শরফ উদ্দিন
তথ্যসূত্র: দৈনিক নয়াদিগন্ত