সোমবার, ১৯ জুলাই, ২০১০

মাশরুম চাষ

মাশরুম চাষ

মাশরুম পুষ্টিকর এবং ওষুধিগুণসম্পন্ন একটি উৎকৃষ্ট সবজি। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু মাশরুম চাষের জন্য উপযোগী। মাশরুম চাষের উপকরণ খড়, কাঠের গুঁড়া, আখের ছোবড়া অত্যন্ত- সস্তা ও সহজে পাওয়া যায়। এ সবজিটি ঘরের মধ্যে চাষ করা যায় এবং মাত্র ৭-১০ দিনের মধ্যেই মাশরুম পাওয়া যায় যা অন্য ফসলে পাওয়া যায় না। চাষাবাদে কোন খরচ নেই বললেই হয়। জমির প্রয়োজন হয় না।

বর্তমানে বাংলাদেশে চাষকৃত মাশরুম হচ্ছে কিং ওয়েস্টার, বাটন, শিতাকে, ইনোকি, মিল্কী হোয়াইট, বীচ, স্যাগী, নামেকো, পপলার ও স্ট্র ।


খড়ের বেডে মাশরুম চাষ সাধারণত দুধাপে সম্পন্ন হয়ে থাকে। প্রথম ১৭ থেকে ২০ দিন ওমঘর ঘরে তারপর ফসল উৎপাদনের জন্য চাষঘরে ২১ দিন থেকে ৪৫ দিন। ওমঘর ব্যবস্থাপনা এবং চাষঘর ব্যবস্থাপনা তথা স্ব স্ব ক্ষেত্রে যথাযথভাবে পরিবেশ নিয়ন্ত্রণই হল এ চাষের মূল কৌশল।


মাশরুম চাষা করতে বীজ, ধানের খড়, পাতলা পলিথিন ব্যাগ, ঝুলন- শিকা বা বাঁশ, ছিদ্রযুক্ত কালো পলিথিন সিট, ঘরের উষ্ণতা ও আদ্রর্তা পরিমাপের জন্য হাইগ্রোমিটার, ঘরের উষ্ণতা ও আদ্রর্তা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য হ্যান্ড সপ্রেয়ার, জীবাণুনাশক, ব্লেড বা ছোট ছুরি, বালতি, আনুসাঙ্গিক অন্যান্য উপকরণ।


মাশরুম উৎপাদন পদ্ধতি : বীজ প্যাকেট প্রস-তকরণ; সাদা মাইসেলিয়াম সমৃদ্ধ মাশরুমের বীজ প্যাকেটের মুখ বন্ধ থাকলে রাবার ব্যান্ড, কাগজ, তুলা ও প্লাস্টিক নেক খুলে আলাদা করে আবার প্যাকেটের মুখটি শুধু রাবার ব্যান্ড দিয়ে পেচিয়ে ভালভাবে আটকাতে হবে; তারপর কম্পোস্ট প্যাকেটের উপরের দুপাশে (বিপরীত দিকে) ব্লেড দিয়ে গোলাকার বা চোখের আকৃতি করে ৩-৪ সে.মি. পলিথিন ব্যাগ কেটে ফেলতে হবে; কাটা অংশে চা চামচ দিয়ে ১ সে.মি. গভীর করে কম্পোস্ট চেঁছে ফেলতে হবে। এ ব্যবস্থাকে মাশরুম উৎপাদনের জন্য উদ্দিপ্তকরণ বলে; কম্পোস্ট প্যাকেট গুলো এবার একটি সুবিধামত পাত্রে পরিষ্কার পানিতে ৩০ মিনিট পর্যন- ডুবিয়ে রাখতে হবে; পানির পাত্র থেকে প্যাকেটগুলো উঠিয়ে পরিষ্কার স্থানে ৩০ মিনিট পর্যন- উল্টো করে রাখতে হবে যাতে প্যাকেটের বাড়তি পানি ঝরে পড়ে; এখন কম্পোস্ট প্যাকেটগুলো মাশরুম চাষের জন্য প্রস্তুত হল। মাশরুম উৎপাদনের ঘরে মাচার উপর প্রয়োজন অনুযায়ী একটি ভেজা পলিথিন পেতে উক্ত কম্পোস্ট প্যাকেটগুলো মাচার উপর রাখতে হবে এবং আর একটি পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।


পলিথিন দিয়ে প্যাকেটগুলোকে ২-৩ দিন ঢেকে রাখতে হবে। তবে প্রতিদিন সকাল-দুপুর-বিকেল মোট ৩ বার প্যাকেটের উপরের ঢাকনা ১০ মিনিট পর্যন- সরিয়ে রাখতে হবে যেন এ সময় বাতাস চলাচল করতে পারে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে পলিথিনের উপরে হালকাভাবে পানি সপ্রে করতে হবে, অথবা ঘরের ভেতরের চারপাশে চট ভিজিয়ে রাখা যেতে পারে।


মাশরুম উঠানোর পর গোড়া থেকে ১-২ সে.মি. মত কেটে বোঁটাসহ ছিদ্রযুক্ত পলিথিন ব্যাগে বাজারজাত করা ভাল। তবে বিশ্বাসযোগ্যতা ও দূষণমুক্ত রাখার জন্য পলিথিন প্যাকেটের মুখ বন্ধ করে বাজারজাত করা দরকার। সাধারণ তাপমাত্রায় মাশরুম ১২-১৫ ঘন্টা ভাল থাকে। ফ্রিজের সবজি রাখার স্থানে রাখলে ৩-৪ দিন পর্যন- ভাল থাকে। তবে এ মাশরুম রোদে শুকিয়ে অনেকদিন রাখা যায়। মাশরুম উঠানোর পর সুন্দর করে বোঁটা কেটে রোদে প্রতিদিন ৭-৮ ঘন্টা করে ৩-৪ দিন শুকিয়ে সংরক্ষণ করলে ১ বছর পর্যন- শুকনো মাশরুম ভাল থাকে।


মাশরুমে রোগ-বালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ অনেক কম। শুধু খড়ের বেড তৈরির সময় আগাছা বাছাই করে ফেললে আগাছার প্রকোপ থাকবে না। আর মাছিপোকা ও তেলাপোকা দমনের জন্য আঠার ফাঁদ, নকরোচ ব্যবহার করলেই চলে।


মাশরুম দিয়ে মাশরুম ফ্রাই, আমিষ সমৃদ্ধ সু্যপ, মাশরুম চিকেন সু্যপ, মাশরুম চিংড়ি, মাশরুম স্যান্ডউইচ, মাশরুম সস, মাশরুম পোলাও ও মাশরুম ওমলেট তৈরি করা যায়।


বর্তমানে সারা পৃথিবীতে মাশরুম খাদ্য হিসেবে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করছে। কারণ, মাশরুমে অনন্য শাকসবজি ও ফলের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি আমিষ থাকায় উন্নত বিশ্বের লোকেরা একে সবজি মাংস হিসেবে অভিহিত করে। তাছাড়া রোগমুক্ত স্বাস্থ্যের জন্য নিয়মিত মাশরুম রাখতে হবে আমাদের খাবার তালিকায়।

উচ্চ ফলনশীল সুস্বাদু মুখী কচুর চাষ

উচ্চ ফলনশীল সুস্বাদু মুখী কচুর চাষ

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত ১৮/২০টি জাত হতে গবেষণার মাধ্যমে বিলাসী নামে একটি উফশী জাত উদ্ভাবন করা হয় এবং ১৯৮৮ অনুমোদনকরা হয় জাতটি। বিলাসী গুণে উৎকৃষ্টও উচ্চ ফলনশীল। বিলাসী মুখী কচুর জাত।

মুখী কচু একটি সুস্বাদু সবজি। এ সবজি খরিফ মৌসুমের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই এর চাষ হয়। মুখী কচু বাংলাদেশে গুড়াকচু, কচু, ছড়া কচু, দুলি কচু, বিন্নি কচু ইত্যাদি নামেও পরিচিত। মুখীর ছড়া বীজ হিসেবেব্যবহার করা হয়। মুখী কচুর গাছ হলদে হয়ে শুকিয়ে গেলে এ কচু তুলতেহয়। এতে ৬ থেকে ৭ মাস সময় লাগে।


বিলাসী জাতের গাছ সবুজ, খাড়া, মাঝারি লম্বা, এর মুখী খুবমসৃণ, ডিম্বাকৃতির হয়।সিদ্ধ মুখী নরম ও সুস্বাদু। সিদ্ধ করলে মুখীসমানভাবে সিদ্ধ হয় ও গলে যায়।


বিলাসীর জীবনকাল ২১০ থেকে ২৮০ দিনের। সাধারণ অবস্থায় এর ফলনহেক্টর প্রতি প্রায় ২৫ থেকে ৩০ টন। উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে হেক্টর প্রতি ৪০ টন পর্যন্ত ফলন হয়ে থাকে। দো-আঁশ মাটি এই জাতের জন্য উত্তম।


রোপণের সময় : মধ্য মাঘ থেকে মধ্য ফালগুন। মধ্য চৈত্র থেকে মধ্য বৈশাখ।


রোপণ পদ্ধতি : উর্বরা মাটির জন্য সারি থেকে সারির দূরত্ব ৭৫সেঃ মিঃ গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৪৫ সেঃ মিঃ। অনুর্বর মাটির বেলায় সারি থেকে সারির দূরত্ব ৬০সেঃ মিঃ এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৪০ সেঃ মিঃ রাখতে হয়।


বীজরে পরিমাণ : ২ থেকে ২.৫ গ্রাম (প্রতি শতাংশে এবং ছড়ার ওজন১৫ থেকে ২০ গ্রাম)


বীজ বপনের গভীরতা : ৮ থেকে ১০ সেঃ মিঃ


উৎপাদন :১০০ থেকে ১২০ কেজি (প্রতি শতাংশে)


সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি :

গোবর/কম্পেস্ট সার ১০ কেজি, ইউরিয়া ৪০০গ্রাম, টিএসপি ৫০০ গ্রাম, এমওপি ৪০০ গ্রাম, জিপসাম ২০গ্রাম, জিং ৫গ্রাম। গোবর, টি এসপি এবং এমওপি রোপণের সময় এবং ইউরিয়া ৪০ থেকে ৪৫ দিনপর প্রয়োগ করা ভাল।

অন্তরর্বর্তীকালীন পরিচর্যা :

১. সার উপরি প্রয়োগের পর গাছের গোড়ার মাটি টেনে দিতেহবে। জমিআগাছা মুক্ত করা, খরার সময় প্রয়োজনে সেচ দেওয়া এবং অতি বৃষ্টিতে পানিনিস্কাশনের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।

২. মুখী কচু মাটির নিচে হয় বলে মাটি ঝুরঝুরা রাখাবাঞ্চনীয়।


৩. গাছের গোড়া মালচিং এর মাধ্যমে ঢেলে দিলে গুড়ি চারার সংখ্যাকমে আসে তাতে ছড়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।

৪. গাছের পাতা ছোট হয়ে হলুদ বর্ণ ধারণ করলে ফসল সংগ্রহ করাউচিত।

মুখী কচু চাষাবাদ করতে গিয়ে কোন সমস্যায় পড়লে আপনি কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরে কর্মরত নিকটস্থ উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন।

জলবায়ু পরিবর্তন

জলবায়ু পরিবর্তন

পরিবেশে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের উপাদানের সমাহার। এই বিদ্যমান সুনিবিড় সুশৃঙ্খল বন্ধন কোননা কোনভাবে ছিন্ন হলে শুরু হয় প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ফলে মানুষের জীবন হয়ে পড়ে সমস্যাসংকুল। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এখন জলবায়ুর পরিবর্তনের সাথে সাথে বিভিন্ন ধরনের দূষণ শুরু হয়েছে, নদী দূষণ, লাগামহীন বর্জ্য উৎপাদন, অপ্রতুল ব্যবস্থাপনা, বনাঞ্চল নিধন প্রক্রিয়া। বিজ্ঞানীরা পৃথিবীব্যাপি এ পরিবেশ বিপর্যয়ের মূলে বৈশ্বিক উষ্ণতা অর্থাৎ জলবায়ুর পরিবর্তনকে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

বিজ্ঞানীরা যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন যে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর উপকুলীয় অঞ্চল সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের সম্মুখিন হবে, বঙ্গোপসাগরের মুখে অবস্থিত বাংলাদেশের ওপর আঘাতটা সবচেয়ে কঠিন হবে; তা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ঘটতে শুরু করেছে। উপকুলীয় অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা ও উষ্ণতা বেড়ে গেছে। বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে খরা, আবার অন্য অঞ্চলে অত্যধিক বৃষ্টিপাতসহ বন্যা, সাইক্লোন ও হারিকেনের মত বিধবংসী ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তান্ডব এ দেশের মানুষ, বিশেষ উপকুলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবনে বিভীষিকা সৃষ্টি করে চলেছে। এর স্বাক্ষর গত বছর পর পর ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘুর্ণিঝড়- সিডর, আইলা। যার দুর্ভোগ এখন দীর্ঘসময় পর্যন্ত মানুষকে বহন করতে হচ্ছে। আইলার তান্ডবে দক্ষিণাঞ্চলের বেড়িবাঁধ, কাঁচারাস্তা, ঘরবাড়ি, সামাজিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মাছের ঘের, ফসলের ক্ষেত সব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঐ অঞ্চলের জেলেদের জীবিকার একমাত্র উৎস জাল-নৌকা আর কৃষকের হালের গরু-লাঙ্গল সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, কেড়ে নিয়েছে সন্তান, পরিবারের সদস্যদের। চর এলাকার বাঁধ ভেঙ্গে পানি ঢুকে গ্রামগুলিতে স্থায়ী হয়ে যায় দীর্ঘদিন। এইসব এলাকার বাসিন্দারা যেখানে সাইক্লোন সেন্টার আছে সেখানেই গাদাগাদি করে আশ্রয় নিয়েছিল আর অনেককে থাকতে হয়েছে খোলা আকাশের নীচে। প্রয়োজনের তুলনায় ত্রানের খাদ্য ও অন্যান্য সব কিছু ছিল অপ্রতুল; সবচেয়ে দুর্ভোগ হয় খাবার পানির। সকল গভীর ও অগভীর নলকুপ পানির নীচে। এখানকার মানুষজন নদী আর খালের পানি পান করে জীবন যাপন করেছে। এখানকার কিছু এলাকায় বিভিন্ন সংস্থা থেকে যেসব ঘরবাড়ি পাকা নির্মাণ করে দিয়েছিল আইলার বাঁধ ভাঙ্গা পানি এস তা সব ধ্বংস করে দিয়েছে। আইলার আঘাত ও জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে শত শত চিংড়ি ঘের, ফলে ব্যবসায়ীরা সর্বশান্ত হয়ে গেছে। এর জের ধরেই পটুয়াখালির প্রায় ১৩ লাখ হাজার হেক্টর ফসলি জমি এবার অনাবাদি থাকার আশংকা করা হচ্ছে লবণাক্ততা ও জমে থাকা পানির কারণে।
আইলাদুর্গত হাজার হাজার মানুষ এখন পর্যন্ত তাদের বসতভিটায় ফিরতে পারছে না বাঁধ ভাঙ্গা পানির স্থায়ীত্বের কারণে। তারা বসবাস করছে ওয়াবদা রাস্তার উপরে, খোলা আকাশের নীচে। তাদের কর্মসংস্থান নেই, নির্ভর করতে হচ্ছে ত্রানের উপর কিন্তু জুলাই মাসের পর থেকে সরকারীভাবে ত্রানও বন্ধ, মাথা গোঁজার ঠাই নেই স্যানিটেশনের কোন ব্যবস্থা নেই ফলে পরিবেশ আরো বিপর্যয় আর বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। বিপর্যস্ত অনেক পরিবার বাঁচার আশায় শহরে এসে বস্তিতে দুর্বিসহ জীবন-যাপন করছেন। কৃষক শহরে এসে রিকশা কিংবা ঠেলাগাড়ি কিংবা নিম্নমানের কাজ করে জীবন চালাচ্ছেন। পরিবারের মেয়েরা করছেন ঝি কিংবা শ্রমিক হিসেবে অন্যান্য কাজ। শহরে বসবাসকারী লোকসংখ্যার চাপ বাড়ছে দিন দিন। ঐতিহ্যবাহী জীবন-যাপন আর মানুষের স্বাভাবিক বেড়ে উঠা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।