বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কৃষি ও প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। বাংলাদেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ আসে কৃষি থেকে। জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষির এ অবদান অন্যান্য এশীয় দেশগুলোর চেয়ে বেশি (পাকিস্তানের জিডিপির ২৫ শতাংশ, থাইল্যান্ডের ১০ শতাংশ, ফিলিপাইনের ২২ শতাংশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশসমূহের জিডিপির ৩০ শতাংশ) আসে কৃষি থেকে, এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমহ্রাসমান হলেও এখনও অনেকের তুলনায় বেশী। এ দেশের শতকরা ৭০ জনেরও বেশি মানুষ গ্রামে বাস করে, যাদের প্রধান পেশা কৃষি।
গ্যাট চুক্তির অষ্টম রাউন্ড অর্থাৎ উরুগুয়ে রাউন্ডে প্রথমবারের মতো কৃষির অন্তর্ভুক্তি ঘটে। তার মানে এই নয় যে বিশ্ব বাণিজ্যে কৃষিজ পণ্যের বেচাকেনা করে। উন্নত দেশসমূহ তাদের অভ্যন্তরীণ কৃষিনীতিকে আড়াল করার জন্যই কৃষিজাত সামগ্রী বাজারজাত করে তারা বিস্তর মুনাফা কামিয়েছে। শিল্প খাতের আয়কৃত অর্থে আধুনিকীকরণ করেছে পুরো কৃষি ব্যবস্থা। প্রচুর ভর্তুকি দিয়ে কৃষিকে বৃহৎ খামারে পরিণত করেছে, ফলে উৎপাদনও বেড়েছে ঢের। কিন্তু কেউ কখনো তলিয়ে দেখেনি যে, কৃষিজ পণ্যের উৎপাদন খরচ ও বিক্রয় মূল্যের মধ্যে তফাতটা কতটুকু।
আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ডাইরেক্টর জেনারেল ড. রোনাল্ড পি ক্যানট্রিল তার এক গবেষণায় উন্নত ও অনুন্নত কতিপয় দেশের ধান উৎপাদনের তুলনামূলক খরচ ও অভ্যন্তরীণ বাজার দেখিয়েছেন এভাবেই- (১৯৯৪ সালের তথ্য)
দেশ | ধান উৎপাদন টন প্রতি হেক্টর | উৎপাদন খরচ ইউএস ডলার প্রতি টন | অভ্যন্তরীণ মূল্য ইউএস ডলার প্রতি টন |
জাপান | ৬.৫ | ১৯৮৭ | ১৭৩০ |
যুক্তরাষ্ট্র | ৬.৩ | ২২০ | ১৬৭ |
কোরিয়া | ৬.৬ | ৯৩৯ | ৯৫৭ |
থাইল্যান্ড | ১.৮ | ১২০ | ১৪১ |
ভিয়েতনাম | ৪.৫ | ১০০ | ১৩০ |
ফিলিপাইন | ২.৬ | ১২৪ | ১৬০ |
ইন্দোনেশিয়া | ৫.৮ | ১১৭ | ১৩২ |
বাংলাদেশ | ৪.৬ | ১৩৮ | ১৮০ |
উপরিউক্ত তথ্যে দেখা যায় যে, শিল্পোন্নত ও অনুন্নত দেশের ধান উৎপাদন খরচের ব্যবধান খুবই বেশি। যদিও অভ্যন্তরীণ বাজারে ধানের মূল্য তুলনামূলক হারে বেশি কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে এর মূল্য অবশ্যই অনুন্নত দেশের মূল্যমানের কম। এতে স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, শিল্পোন্নত দেশের কৃষি ব্যবস্থা সার্বিকভাবেই ভর্তুকিনির্ভর। এভাবে ভর্তুকি দিয়ে নিজেদের কৃষি ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার চেয়ে উন্নত বিশ্বের বড় যে তাড়না ছিল তা হলো অনুন্নত বিশ্বের কৃষিকে কোনো না কোনোভাবে ঠেকানো। কিন্তু এভাবে আর কতদিন রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় ঘটবে। বিষয়টি নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার মতোই।
আঙ্কটাডের এক রিপোর্টে দেখা যায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় জোট আর জাপান মিলে বছরে ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি কৃষিতে প্রদান করে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট ওইসিডি ১৯৮৮ সালে একটি হিসাবে দেখায় যে, ১৯৮৪-৮৬ সালের মধ্যে কৃষিতে সবকিছু মিলিয়ে টাকা ফেরত গেছে ১৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১৯৭৯-৮০ সালের মধ্যে এর পরিমাণ ছিল ৮৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই দুই সময়পর্বে কৃষিক্ষেত্রে সাকুল্যে খরচ বেড়েছে, ইউরোপীয় জোটের দেশগুলোতে শতকরা ৪০ ভাগ, জাপানে দ্বিগুণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের ক্ষেত্রে দ্বিগুণেরও বেশি। রাষ্ট্রীয় কোষাগার এই খরচ কুলিয়ে উঠতে পারছে না বিধায় কৃষিতে গ্যাটের অষ্টম রাউন্ডে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আলোচনায় সম্পৃক্ত করে।
কৃষিকে পুরোপুরি বাজারে ছেড়ে দিতে কেউই রাজি ছিল না, তারপরও বাধ্য হয়েই কৃষি বাণিজ্য কতিপয় বিধিমালা আরোপিত হয়, যেমন-
এক. কৃষি বিষয়ক চুক্তি।
দুই. স্যানিটারি ও ফাইটোস্যানিটারি বিষয়ক চুক্তি।
তিন. বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিজাত সম্পত্তির ওপর অধিকার। সংক্ষেপে ট্রিপস
আমাদের কৃষিতে উপরিউক্ত চুক্তিসমূহ কী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে তা একটু খতিয়ে দেখা যাক-
কৃষি ক্ষেত্রে ভর্তুকির কথা বিবেচনায় আনলে দেখা যায় যে, শিল্পোন্নত দেশগুলোতে কৃষিপণ্যের ওপর ভর্তুকি ঠিকই থেকে গেল। শিল্পোন্নত দেশগুলো যদি তাদের কৃষিতে শত ভাগ ভর্তুকি প্রদান করে এবং চুক্তি মোতাবেক যদি শতকরা ২০ ভাগ ভর্তুকি কমায়, তবে এখনো ৮০ ভাগ ভর্তুকি থেকেই গেল। শিল্পোন্নত দেশগুলো যে তাদের কৃষিতে শত ভাগ ভর্তুকি প্রদান করে তা প্রমাণিক সত্য। কারণ, তাদের উৎপাদন খরচ অভ্যন্তরীণ বাজার দরের চেয়ে বেশি। সুতরাং শত ভাগ রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি ছাড়া কেউ কৃষি কাজ করবে না।
অন্যপক্ষে অনুন্নত দেশ কৃষিতে ভর্তুকির হার এমনিতেও কম, তারপরও কমিয়ে যদি ১০ শতাংশ পর্যন্ত রাখা হয় ও অন্যান্য ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সমর্থন বা ব্যয় প্রত্যাহার করা হয় তবে কৃষি উপকরণের দাম বেড়ে যাবে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। অন্যদিকে কৃষিপণ্য রপ্তানি ভর্তুকির সুযোগ থাকলেও দুর্বল অর্থনীতির কারণে বাংলাদেশে তা পারবে না। ফলে আমাদের দেশের কৃষিপণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না। এর আবার অন্য হিসাবও আছে। যেমন- বর্তমানে (১৯৯৪ সালে) বাংলাদেশে প্রতি টন ধানের উৎপাদন খরচ ১৩৮ ডলার এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রয় মূল্য প্রতি টন ১৮০ ডলার। কৃষি খাতে যদি রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হয় তবে উৎপাদন খরচ বাড়বে নিশ্চিত। এখনো এ ধরনের প্রভাব কৃষিতে লক্ষণীয়। ফলে প্রান্তিক চাষি, বাংলাদেশের শতকরা ৭০ ভাগ লোক কৃষিতে উৎসাহ হারাবে। শুরু হবে কৃষি শিল্পায়ন, একক প্রজাতির শস্যের আবাদ, অধিক ফলনের আশায় বিপুল সার কীটনাশক প্রয়োগ, এমনকি সর্বনাশা হাইব্রিড শস্যের আবাদে বিনষ্ট হবে বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্য পারিবারিক কৃষি ব্যবস্থা।
যদিও বলা হচ্ছে, কৃষিতে ভর্তুকি চলবে না, কমাতে হবে, তবুও উন্নত দেশগুলো কিন্তু তাদের কৃষিতে ভর্তুকি প্রদানের পথ সৃষ্টি করেই রেখেছে। এগুলো হলো গ্রিন বক্স এবং ব্লু বক্স পলিসি। গ্রিন বক্স পলিসিতে বলা হলো, যে ব খাত কৃষি পণ্যের দামে সরাসরি প্রভাব ফেলবে না যেমন, কৃষি গবেষণা, সমপ্রসারণ কর্মকাণ্ড, বালাই প্রতিরোধ ও অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক খরচ ইত্যাদিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে অর্থায়ন করা যাবে। এখানে চাতুরিটা এই যে, উন্নত দেশগুলো গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন কৃষি প্রযুক্তি, বীজ, সার, বালাইনাশক উৎপাদন করবে আর আমরা তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহ তাদের কাছ থেকে নতুন প্রযুক্তি কিনব, টন টন বীজ, সার বালাইনাশক কিনব। কৃষি পণ্য উৎপাদন করব এবং তা কাঁচামাল হিসেবে উন্নত দেশসমূহ স্বল্পমূল্যে কিনে নেবে।
কৌশলের দুটো দিক
এক. উন্নত দেশসমূহ এত দিন কৃষিতে শিল্পায়ন ঘটিয়ে, ব্যাপক রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি দিয়ে টনে টনে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, জমিতে ঢেলেছে। গাছপালা, প্রাণবৈচিত্র্য, পোকামাকড়, অণুজীব ধ্বংস করেছে। পরিবেশকে করেছে মারাত্মক সমস্যাগ্রস্ত। খাদ্যের মধ্যেই বিষ এসে মুখের গ্রাসে ঢুকছে। এখন পরিবেশ সংরক্ষণ ও নিজে বাঁচার তাগিদ ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে উদ্ভাবিত সব প্রযুক্ত ঠেলে পাঠাচ্ছে আমাদের দিকে। যাতে আমাদের যা আছে তাও হারিয়ে পুরোপুরি নির্ভরশীল হই উন্নত বিশ্বের ওপর এবং তারা কৃষি উপকরণের ব্যবসায় মুনাফা লুটুক দুমুঠো ভরে।
দুই. যেহেতু তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহ প্রযুক্তিগতভাবে দুর্বল এবং এখনো কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যাপক প্রযুক্তি ও সফলতা নেই, সেহেতু কৃষি কাঁচামালই আমাদের বিক্রি করতে হবে।
ট্রিপস এর অর্থ হলো বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিজাত সম্পত্তির অধিকার। এই চুক্তিতে নতুন যে বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে তা হলো বুদ্ধিজাত সম্পত্তি। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাদের বুদ্ধি বা মেধা খাটিয়ে যদি কোনো নতুন সামগ্রী বা ডিজাইন বা কলাকৌশল আবিষ্কার ও সৃষ্টি করে তবে সেগুলো বুদ্ধিজাত সম্পত্তি হিসেবে ধরা হয়। শুধু তাই নয়, জমি ও প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানসমূহও মালিকানা, দখলদারিত্ব, অধিকার প্রভৃতি আইন করে বাণিজ্যে সম্পৃক্ত করা হয়েছে ট্রিপস চুক্তির মাধ্যমে।
একটা সময় ছিল, যখন বিশ্বাস করা হতো বিজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারসমূহ মানুষের সাধারণ সম্পত্তি, তাতে ছিল আমজনতার অধিকার। বিজ্ঞানীরাও সভ্যতার বিকাশের জন্য, মানুষের উপকারের জন্য নির্লোভ ও নিরলসভাবে হয়ে কাজ করে গেছেন আজীবন। ইতিহাস সেইসব মহৎপ্রাণকে আজও স্মরণ করে পরম শ্রদ্ধায়।
দুই. যেহেতু তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহ প্রযুক্তিগতভাবে দুর্বল এবং এখনো কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যাপক প্রযুক্তি ও সফলতা নেই, সেহেতু কৃষি কাঁচামালই আমাদের বিক্রি করতে হবে।
ট্রিপস এর অর্থ হলো বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিজাত সম্পত্তির অধিকার। এই চুক্তিতে নতুন যে বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে তা হলো বুদ্ধিজাত সম্পত্তি। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাদের বুদ্ধি বা মেধা খাটিয়ে যদি কোনো নতুন সামগ্রী বা ডিজাইন বা কলাকৌশল আবিষ্কার ও সৃষ্টি করে তবে সেগুলো বুদ্ধিজাত সম্পত্তি হিসেবে ধরা হয়। শুধু তাই নয়, জমি ও প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানসমূহও মালিকানা, দখলদারিত্ব, অধিকার প্রভৃতি আইন করে বাণিজ্যে সম্পৃক্ত করা হয়েছে ট্রিপস চুক্তির মাধ্যমে।
একটা সময় ছিল, যখন বিশ্বাস করা হতো বিজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারসমূহ মানুষের সাধারণ সম্পত্তি, তাতে ছিল আমজনতার অধিকার। বিজ্ঞানীরাও সভ্যতার বিকাশের জন্য, মানুষের উপকারের জন্য নির্লোভ ও নিরলসভাবে হয়ে কাজ করে গেছেন আজীবন। ইতিহাস সেইসব মহৎপ্রাণকে আজও স্মরণ করে পরম শ্রদ্ধায়।
সময় বলেছে, বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ মুনাফামুখী হয়ে পড়ছে দিনকে দিন। বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এখনে কর্পোরেট সম্পত্তি। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এখন বৈজ্ঞানিক নিয়োগ দেয়। আবিষ্কার করে নতুন নতুন সামগ্রী বা ডিজাইন বা কলাকৌশল। যেগুলো ওই কোম্পানির পণ্য হিসেবে বিশ্বে পরিচিত লাভ করে।
বুদ্ধিজাত সম্পত্তির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস * ১৪৭৪ খ্রিষ্টাব্দে ভেনিস নগর রাষ্ট্র সর্ব প্রথম প্যাটেন্ট আইন চালু করে। তখন প্যাটেন্ট অধিকার সংরক্ষিত ছিল এই বলে যে, দাবিকৃত আবিষ্কারে বা উদ্ধাবনের ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখাতে হবে। * ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের সময় প্যাটেন্ট নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। কোনো আবিষ্কার বা উদ্ভাবন হতে আইনের মাধ্যমে সমাজের সবাইকে বঞ্চিত করার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। * ১৭৯১ সালে ফ্রান্সের প্যাটেন্ট আইনে বলা হয় যে, আবিষ্কার তার আবিষ্কারের ওপর একচেটিয়া অধিকার লাভ তার প্রাকৃতিক অধিকার। * ১৭৯৪ সালের প্যাটেন্ট আইন অস্ট্রিয়া মেনে নেয়নি। তাদের মতে, প্যাটেন্ট প্রাকৃতিক অধিকার তো নয়ই, বরং একটি অস্বাভাবিক ব্যাপার। * দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো ঔপনিবেশবাদ হতে স্বাধীন হতে থাকলে, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও উন্নয়নের প্রশ্নে প্যাটেন্ট ব্যবস্থা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। * ১৯৬৫ সালে জাতিসংঘ The Role of Patents in the Transfer of technology to developing countries শিরোনামে একটি বই প্রকাশ করে, যেখানে যেখানে প্যাটেন্ট বিষয়ক নতুন দিকনির্দেশনা আসে। * ১৯৭২ সারে চিলির সান্টিয়াগো শহরে আঙ্কটাডের তৃতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে জাতিরসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল আঙ্কটাডের সেক্রেটারি জেনারেল ও WIPO (World International Property Organisation)-এর ডিরেক্টর জেনারেল ঐকমত্যের ভিত্তিতে The Role of Patents in teh Transfer of technology to developing countries বইটিকে সমসাময়িক পরিস্থিতি বিবেচনায় নতুন করে লিখতে উদ্যোগী হন। * ১৯৭৫ সালে The Role of Patents in teh Transfer of technology to developing countries নতুনভাবে প্রকাশিত হয়। যেখানে বলা হয় প্যাটেন্ট, ট্রেডমার্ক বা শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সম্পত্তিমূলক অধিকার স্বাভাবিক বা প্রকৃতিপ্রদত্ত কোনো অধিকার নয়। * ১৯৮৩ সারে ইউরোপ ও ল্যাতিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশ প্যাটেন্ট ব্যবস্থার আন্তর্জাতিক ছক হিসেবে পরিচিত প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। * ১৯৮৭ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। |
প্যাটেন্ট ও প্যাটেন্ট আইনের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় দেখা যায় যে, এ সব কার্যকলাপে শুধু উন্নত দেশসমূহই সম্পৃক্ত ছিল এবং এ নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনা, সমঝোতা ও চুক্তি করার ভিন্ন ফোরাম ছিল। এ ক্ষেত্রে World International Property Organisation (WIPO) ছাড়াও জাতিসংঘ ও আঙ্কটাড কথা বলেছে বিভিন্ন সময়। তবুও উন্নত দেশগুলো এ বিষয়টিকে বিশ্ব বাণিজ্য চুক্তির আওতায় এনেছে। এর প্রধান কারণ হলো, যদি কোনো দেশ শিল্পোন্নত দেশের কোনো কোম্পানির বুদ্ধিজাত সম্পত্তির অধিকার খর্ব করে তাহলে অনায়াসেই শাস্তি দেওয়া যাবে। কারণ, যেসব দেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে, তাদের অবশ্যই এ সম্পর্কিত সব চুক্তি মেনে চলতে হবে। অন্যথায় এক খাতের পরিবর্তে আরেক খাতে নিষেধাজ্ঞার আওতায় প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ তো রইলই।
বাংলাদেশসহ দ. এশিয়ার অন্যান্য দেশ (উন্নয়নশীল দেশ) উদ্ভিদ, গাছগাছড়া, প্রাণী, অণুজীবসহ অন্যান্য প্রাণ বৈচিত্র্যের বিপুল সম্ভার। কৃষি এসব দেশে তথাকথিত শিল্প হিসেবে বিকশিত না হলেও প্রথাগত ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও অধিকাংশ মানুষের জীবিকার একমাত্র মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত। এখনো প্রাণসম্পদের ওপর নিজস্ব মালিকানা বা অধিকার বলতে কখনো কিছু ছিল না। তাই কৃষিতে বুদ্ধিজাত সম্পত্তির অধিকার বলবত নেই। প্রথম গ্যাট চুক্তির মাধ্যমে কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ ও প্রাণ সম্পদের ওপর বুদ্ধিবৃত্তির অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হলো।
ট্রিপসের ২৭নং চুক্তিনামায় বলা আছে, যেকোনো আবিষ্কারেই প্যাটেন্টের আওতাভুক্ত হবে। হোক তা উৎপন্ন সামগ্রী বা উৎপাদন প্রক্রিয়া। এটাকে ঘুরিয়ে অন্যভাবেও বলা হয়েছে পরে, যার অর্থ হলো কোনো না কোনো ধরনের বুদ্ধিজাত সম্পত্তির ধরন প্রবর্তন করতেই হবে। প্যাটেন্ট ব্যবস্থা চালু করতেই হবে সেটা না বলে বলা হচ্ছে যে, প্যাটেন্ট করো অথবা আপনা-আপনি বুদ্ধিজাত সম্পত্তির মালিকানা সৃষ্ট হয়ে যায় এমন কোনো স্বীকৃত কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যাকে ডব্লিউটিওর ভাষায় Effective Sovigeners System বলা হচ্ছে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় যে, বিভিন্ন দেশ নিজেদের মতো করে আপনা-আপনি নির্ণীত ও স্বীকৃত বুদ্ধিজাত সম্পত্তির মালিকানা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবে। কিন্তু আদতে তা নয়। এখানে কার্যকর কথাটাই গোলমেলে। অর্থাৎ কোনো দেশ যেকোনো ব্যবস্থা নিলেই চলবে না, সেটা শিল্পোন্নত দেশ, বহুজাতিক কোম্পানি সর্বোপরি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দৃষ্টিতে কার্যকর বলে বিবেচিত হতে হবে।
উন্নত বিশ্বে ইতিমধ্যেই কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে অন্য একটি আন্তর্জাতিক চুক্তির কথা বলছে। এবং অনুন্নত দেশসমূহকে সেই চুক্তিতে স্বাক্ষর করাত চাপ প্রয়োগ বা বাধ্য করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, International Convention for the Protection of Non Verieties of psants (UPV) নামের এই আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেই বুদ্ধিজাত সম্পত্তির মালিকানা ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়।
বস্তুত দেখা যায় নিজস্ব কার্যকর ব্যবস্থা বলতে কিছু নেই। সব ক্ষেত্রেই মোদ্দাকথা হলো প্রাণের ওপর মালিকানা স্বত্ব কায়েম করা।
ট্রিপস চুক্তি অনুসারে কৃষি ক্ষেত্রের যে বিষয়গুলো বাণিজ্যিক কারণে ব্যক্তিগত ও কার্পোরেট সম্পত্তিতে কুক্ষিগত হলো। সেগুলো হলো-
এক. গাছপালার ওপর মালিকানা ব্যবস্থা চালু। নতুন প্রজাতির গাছপালা ও উদ্ভিদের ওপর এর আবিষ্কারক বা তৈরিকারকদের মালিকানা প্রতিষ্ঠা।
UPOV কী? ১৯৬১ সালে ইউরোপের শিল্পোন্নত ছয়টি দেশ নতুন উদ্ভাবিত উদ্ভিদ জাতের সংরক্ষণ ও এর ওপর বাণিজ্যিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য International Convention for the Protection of New Verieties of psants (UPOV) চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এ চুক্তিতে বলা হয়, কেউ যদি (ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান) কোনো নতুন উদ্ভিদ, বীজ বা প্রাণী উদ্ভাবন বা সৃষ্টি করে তবে তার মালিকানা স্বত্ব ওই ব্যক্তি বা কোম্পানির হবে। কৃষক কেবল উদ্ভাবিত জাতের শস্যসমূহ আবাদ করতে পারবে কিন্তু শস্যের বীজের সংরক্ষণ বা একের সঙ্গে অন্যের বীজ বিনিময় করতে পারবে না। তাহলে বিষয়টি এই দাঁড়ালে যে Jui Genesis Act হিসেবে আমাদের যে এর UPOV দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে সেখানেও কৃষি কৃষকের থাকছে না। এখানে উদ্ভিদ বা বীজ বা প্রাণী সৃষ্টির কথাটিও বিভ্রান্তি আসতে পারে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হচ্ছেও তাই। যেমন, নতুন হাইব্রিড ধান তৈরি, নতুন প্রজাতির মাছ তৈরি, উন্নত ধরনের গাভি তৈরি ইত্যাদি। যদিও নতুন কোনো একক প্রাণী সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। তবুও দুটি ভিন্ন ধরনের প্রাণী বা উদ্ভিদের মিলন ঘটিয়ে হমেশাই সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন উদ্ভিদ I প্রাণী। শুরুতে UPOV চুক্তিতে ছয়টি দেশ স্বাক্ষর করলেও ১৯৯০ সালে এর সদস্যসংখ্যা দাঁড়ায় ২০টি এবং ২০০২ সালের মে মাসের মধ্যে ৫০টি দেশও G চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। |
দুই. অণুজীব যেমন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদিতে প্যাটেন্ট বা মালিকানা স্বত্ব প্রণয়ন।
তিন. অণুজীবজনিত প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রেও প্যাটেন্ট ব্যবস্থা চালু।
শেষ পর্যন্ত বিষয়টি এই হলো যে, কৃষকের নিজের বলে কিছু থাকল না, না বীজ, না কৃষি প্রযুক্তি। অথচ কৃষির সেই সৃষ্টি থেকে কৃষক তার নিজস্ব প্রক্রিয়ায় নতুন নতুন শস্যের আবাদ, বীজ সংরক্ষণ, নয়া কৃষি প্রযুক্তির উদ্ভাবন ইত্যাদি করে আসছে।
তবে এ বিষয়টি দেখা দরকার যে, কৃষক কীভাবে এবং কোন চক্রান্তের ফলে আজ সবকিছু হারাতে বসেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে বিবেচনায় আনলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষকের বিপর্যয়ের ইতিহাস খুবই পুরোনো নয়। শিল্পে দেশগুলোর কৃষি সার্বিকভাবেই রাষ্ট্রীয় ভর্তুকির ওপর নির্ভরশীল। ভর্তুকি দিয়ে দিয়ে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে কৃষি পণ্যের কমিয়ে রেখে এতদিন কোনোক্রমে অনুন্নত দেশের কৃষিতে ঠেকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু এতে উল্টো ফলটাই ঘটল। রাসায়নিক ও কীটনাশকনির্ভর চাষাবাদের ফলে একদিকে নিজেদের পরিবেশ এবং প্রাণ বৈচিত্র্য যেমন ধ্বংস হচ্ছে তেমনি উচ্চতর ভর্তুকির ফলে খালি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার। কত দিন আর এভাবে পারা যায়। এর চেয়ে ভালো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো কৃষিজকাজের সুবিধে দেওয়াই ভালো। অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার, কীটনাশক ব্যবহার করে তৃতীয় বিশ্বর দেশগুলো কৃষি উৎপাদন বাড়াক, তাদের পরিবেশের বারোটা বাজাক। ব্যাপারটা ঘটলও তাই, কৃষির পরিবর্তে উন্নত দেশগুলো মনোযোগী হলো নতুন নতুন শস্যের বীজ, কীটনাশক, রাসায়নিক সার উৎপাদনে। বাংলাদেশও এ চক্রান্ত হতে রেহাই পায়নি। পঞ্চাশ-ষাটের দশকের দিকে কৃষিতে উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে সবুজ বিপ্লবের ধুয়া তোলা হয়। এর পেছনের কারণ ছিল যুদ্ধ-পরবর্তীকালে উন্নত বিশ্ব গড়ে ওঠা রাসায়নিক কারখানায় উৎপাদিত বীজ ও সারের বাজার প্রতিষ্ঠা ও সমপ্রসারণ করা। তৃতীয় বিশ্ব বীজ, পানির পাম্প, সার, কীটনাশক ইত্যাদির বাজার তৈরি করার জন্য তৃতীয় বিশ্বকে এদিকে ঋণ দিয়েছে, অন্যদিকে সবুজ বিপ্লবের গুণগান গেয়ে বহুজাতিকদের পণ্য বিক্রি করছে। এর ফলে যে ভয়াবহ প্রভাবটি আমাদের কৃষিতে পড়েছে তা হলো জমিতে এক জাতীয় শস্যের আবাদ। অর্থাৎ সবুজ বিপ্লবের ঝাণ্ডাধারীদের প্রচারণায় জমিতে শুধু অধিক উৎপাদনশীল ধানের আবাদ করেছি। নির্বিচারে সার, কীটনাশক দিয়েছি জমিতে। জমির স্বাস্থ্য নষ্ট হয়েছে, ঊর্বরতা কমেছে, অণুজীব মরেছে। আর আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস করেছি। আমাদের এক সময় প্রায় ১২ হাজার ধরনের ধান ছিল, সেটা কমতে কমতে সাত-আটটায় এসে ঠেকেছে। কৃষকরা ক্রমে কৃষিপণ্যের জন্য নির্ভরশীল হচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানির ওপর। যেগুলো এক সময় কৃষকেরই ঘরে সংরক্ষিত থাকত। পরিবারের বয়স্করা তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করতেন, পরস্পরের মধ্যে প্রয়োজন সাপেক্ষে বিনিময় করতেন।
গুটিকত শস্য বা উফশী জাতীয় ধানের চাষাবাদের ফলে খালি ধানের ওপর নজর আবদ্ধ রাখা হয়। কৃষির আধুনিকায়নের ফলে মাছ ও কুড়িয়ে পাওয়া অন্যান্য কাদের যে সর্বনাশটা হয়ে গেছে তার হিসাব আমরা করি না। আবার কৃষির উৎপাদন খরচ ও প্রাপ্তির হিসাবটাও মেলানো হয় না সেভাবে। প্রকৃত অর্থে নতুন জাত উদ্ভাবন করায় কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে যেন নতুন জাত আমাদের প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস না করে।